Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে খরচের বোঝা বড় হবে

উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে খরচের বোঝা বড় হবে

38

ডেস্ক রিপোর্ট: দেশে ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল এবং কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করেছে সরকার। সাত বছর তেল বিক্রি করে ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফার পর গত ছয় মাসে ৮ হাজার কোটি টাকা লোকসানের প্রেক্ষাপটে এ দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতে তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা এবং রাষ্ট্রায়াত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চলতি মূলধনের সংকটকে দাম বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে সরকার।
জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে প্রায় সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় বাড়বে যার প্রভাবে খরচ বাড়বে জনগণের।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ হারে ও পরিমাণে এ মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় সড়ক ও নৌপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে এবং কৃষি, শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে। এর ফলে বাস-লঞ্চ ভাড়ার পাশাপাশি তেলচালিত যানবাহনের খরচ বাড়বে। সেচে খরচ বাড়ায় শস্য ফলনের ক্ষেত্রে বাড়তি ব্যয় হবে। শিল্প এবং বিদ্যুৎ খাতে নতুন খরচ যোগ হওয়ার ফলে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার দামও বাড়বে। এমন প্রেক্ষাপটে বাড়তি খরচের চাপ সামলানোর উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

তবে তেলের দাম বাড়ায় জনগণের উপর সার্বিক ব্যয় বৃদ্ধির চাপ তৈরি হলেও এ খাত থেকে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ সরকারের আয় বাড়বে। বর্ধিত দামে তেল বিক্রি করে এক বছরে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাবদ সরকার ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করবে।

গত শুক্রবার রাতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের খুচরা দাম ৮০ টাকা থেকে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১১৪ টাকা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। লিটার প্রতি অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ৫১ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩৪ টাকা, অকটেনের ৪৬ টাকা এবং পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বেড়েছে। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে নতুন মূল্যহার কার্যকর করা হয়েছে।

মানুষের ওপর যেভাবে চাপ বাড়ছে: বিভিন্ন পণ্যের খুচরা বাজার বিশ্লেষণ এবং গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা ভাইরাস এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আঘাতে দেশে এখন প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, বিস্কুট, নুডলস, সাবানসহ নিত্য দিনের খাবার ও ব্যবহৃত পণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরেই বাড়তি। অথচ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।

এমন অবস্থায় সীমিত আয়ের মানুষ শুধু মাসিক খরচই কমায়নি, সঞ্চয়ও ভেঙেছে। চাকরিজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়েছেন বা তাদের ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যেই গত জুনে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলমান। মূল্যবৃদ্ধির ও খরচবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা হয়ে এলো এবারের তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা।

কোন খাতে কতটুকু জ্বালানি তেল: গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৬৩ লাখ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬২ দশমিক ৯২ শতাংশ জ্বালানি ব্যবহৃত হয় পরিবহন-যোগাযোগ খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ ১৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ তেল খরচ হয় কৃষিতে। বিদ্যুতে ১০ দশমিক ৩৫ এবং শিল্প খাতে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। বাসাবাড়িতে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়। যে খাতে তেলের ব্যবহার যত বেশি সে খাতে এর প্রভাবও তত বেশি হবে। একটি পণ্যের দাম শুধু উৎপাদন নয়, পরিবহন ভাড়ার উপরও নির্ভর করে।

শিল্পে ও উৎপাদনে প্রভাব: উদ্যোক্তারা বলছেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, চাহিদা মতো গ্যাস না পাওয়া, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে এমনিতেই উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার ওপর জ্বালানির দাম হটাৎ এতটা বৃদ্ধির প্রভাবে উৎপাদন খাতের ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। দেশের অভ্যন্তরে তেলের দাম বৃদ্ধি দেশের সামগ্রিক শিল্প খাতে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গতকাল শনিবার এফবিসিসিআই কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ এক দফায় ৪০ থে?কে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করায় বড় ধাক্কা আসবে। বর্তমান পরিস্থিতে সরকার চাইলে ধাপে ধাপে এই দাম বাড়াতে পারত। চলমান পরিস্থিতিতে তেলের দাম বৃদ্ধির ঘটনা খুবই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে। এর প্রভাব আমাদের কৃষি, পণ্য পরিবহন ও যাতায়াতে পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। আর এর ভুক্তভোগী হবেন সাধারণ মানুষ।

বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বিশ্ব বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে, ঠিক তখন আমাদের দেশে অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দেশবাসীকে হতবাক করেছে। এ সিদ্ধান্তের কারণে নিঃসন্দেহে চাপে পড়বে রপ্তানীমুখী শিল্প খাত।

সরকারের আয় বাড়বে: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনগণের পকেটে টান পড়লেও এ খাত থেকে সরকারের আয় বাড়বে। কেননা একই হারে কর আদায় করায় পণ্যের দাম যত বাড়ে সরকারও তত বেশি টাকা আদায় করতে পারে। তবে মূসকের হার কমালে সে আয় কমতে পারে।

২০২০-২১ সালে দেশে প্রায় ৪৬ লাখ মেট্রিক টন (প্রায় ৫৪১ কোটি লিটার) ডিজেল, প্রায় ৩ লাখ ৪ হাজার মেট্রিক টন (প্রায় ৩৩ কোটি সাড়ে ১২ লাখ লিটার) অকটেন, ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৬ টন (৫৩ কোটি ৮৩ হাজার লিটার) পেট্রোল এবং ১ লাখ ১ হাজার ৭৮৩ টন (১২ কোটি ৪২ লাখ ৭৭ হাজার লিটার) কেরোসিন ব্যবহৃত হয়। আগামী এক বছর যদি উল্লিখিত পরিমাণ তেল বিক্রি হয় তা দিয়ে সরকারের আয় হবে ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকার বেশি।

পরিবহনে কতটুকু প্রভাব পড়বে: ডিজেল, অকটেন, পেট্রোলের দাম বাড়ায় বাসভাড়া কিলোমিটারে সর্বোচ্চ ২৯ পয়সা এবং লঞ্চ ভাড়া ৪২ পয়সা বাড়তে পারে বলে প্রাক্কলন করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। গতকাল শনিবার দাম বৃদ্ধির বিষয়ে যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে এ তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রণালয়। ঐ বক্তব্যে বলা হয়, দূরপাল্লার বাসে বর্তমানে (৫২ আসনের) প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সা। ডিজেলের দাম বাড়ানোয় ২৯ পয়সা বেড়ে এ ভাড়া হবে ২ টাকার মতো। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়বে ১৬ দশমিক ২২ শতাংশ। শহর এলাকায় (৫২ আসনের) বাসে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া এখন ২ টাকা ১৫ পয়সা। এটি ২৮ পয়সা বেড়ে ২ টাকা ৪৩ পয়সার মতো হবে। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে বাড়বে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। এছাড়া লঞ্চে বর্তমানে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ২ টাকা ১৯ পয়সা। ৪২ পয়সা বেড়ে এ ভাড়া হবে ২ টাকা ৬২ পয়সা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়বে ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ।

সরকার যা বলছে: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দাম না বাড়ানো হলে চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেওয়া যাবে না। বিকল্প উপায় না পেয়ে দাম বাড়ানো হয়েছে। বর্ধিত দামের পরেও তেল বিক্রিতে বিপিসিকে লোকসান গুনতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারদরের সমান্তরালে দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্য সমন্বয়ের চিন্তাও চলছে।

বিপিসির আগের পুঞ্জীভূত মুনাফা থেকে বর্তমান লোকসানের টাকা দেওয়া যেত কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, বিপিসির উন্নয়ন প্রকল্পে ঐ অর্থের বড় অংশ খরচ করা হচ্ছে ও হবে। সরকার তেমন সিদ্ধান্তই নিয়েছে। মুনাফার টাকা থেকে ভর্তুকি দেওয়ার চিন্তা এখনো পর্যন্ত নেই। সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে-সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন, ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন, জেট-এ-১ পাইপলাইন ও ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন। এছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিটও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের চিন্তাভাবনা চলছে। তবে অন্য বিনিয়োগকারী পেলে নিজস্ব অর্থায়নে সেটি নির্মিত হবে না।

প্রধানমন্ত্রীর বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী বলেন, দাম না বাড়লেও হতো বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। কেউ বলছেন বৃদ্ধির পরিমাণ বেশি। দাম বাড়ানোর বিকল্প ছিল—ভর্তুকি দেওয়া। কিন্তু সেখানে সীমাবদ্ধতা আছে। ইতিমধ্যে সব মিলিয়ে ভর্তুকির পরিমাণ সীমার বাইরে। এখন আরো ভর্তুকি বাড়িয়ে কিংবা বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে মূল্যহার সমন্বয় করা হলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব আরো প্রকট হবে। তাই দাম বাড়িয়ে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

ইত্তেফাক