Home মতামত আহারে, উহুরে! শ্রীলংকা কেন হয় না রে!!

আহারে, উহুরে! শ্রীলংকা কেন হয় না রে!!

46

সরদার মোঃ শাহীন

কী ছেলে, কী মেয়ে; গ্রামে বড় হওয়া আমাদের প্রজন্মের সবাই ছেলেবেলায় কোন না কোন ভাবে “ছিঃ কুতকুত” খেলা খেলেছি। ছিঃ কুতকুত, ছিঃ কুতকুত বলে বলে একদমে মাটিতে আঁকা কয়েকটি ঘর লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে শেষ ঘরে পৌঁছেছি। সেখানে একবার দম ছেড়ে আবার দম নিয়ে ঘুরে পেছনের ঘরে ফিরে এসেছি। ব্যাস, খেলা বলতে এইটুকুই। খুবই সিম্পল কিন্তু অসাধারণ তার উপভোগ। উপভোগের আশায় নিত্যদিন খেলাটি খেলার অপেক্ষায় থাকতাম। অপেক্ষায় থাকতাম, কখন বিকেল হবে।

বিকেল হলেই সোজা দৌঁড়ে ঘরের বাইরে। বাইরে শুধু ছিঃ কুতকুত নয়। আরো একটি খেলা খেলতাম, কাতুকুতু খেলা। এটাও খুব সিম্পল কিন্তু বড় মজার খেলা। অবশ্য খেলা বলতে তেমন কিছুই না। পোলাপাইন একজন আরেকজনকে ধরে সারা গায়ে কাতুকুতু দিতাম; মানে খোঁচাতাম। তাতেই খেলা জমে উঠতো। কাতুকুতুর জ্বালায় একেকজন অস্থির হয়ে উঠতো। আর করতো চিৎকার, চেচামিচি।

অবশ্য কাতুকুতু তেমন জটিল কিছু নয়। হালকা মানের গায়ে ছোঁয়াছোঁয়া খেলা। তবে এর ফলাফল হতো ভারী। কোনভাবেই সহ্য করার মত নয়। সারা গায়ের সংবেদনশীল জায়গায় একটু খোঁচা দিলেই কর্মসারা। বিশেষ করে বগল তলায় দিলে তো কথাই নেই। অধিকাংশই সইতে পারতো না। যে সইতে পারতো, সে বেঁচে যেত। যে পারতো না, সে ফেঁসে যেত। কাতুকুতু সহ্য করা আসলেই এত সোজা নয়।

লক্ষ্য করে দেখলাম, আজকাল এই খেলাটি বাংলাদেশের পোলাপাইন নয়, বরং বড়রা খেলছে। খেলার জন্যে মুখিয়ে থাকছে। আগেও থাকতো। তবে এখন মাত্রাটা মারাত্মক ভাবে বেড়েছে। এরা বিচ্ছিন্ন নয়, বরং সংঘবদ্ধ একটি দল। আমি এদের নাম দিয়েছি কাতুকুতু পার্টি। বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা নতুন ধারা। নতুন দল। করোনার শুরু থেকে মাঠে ময়দানে কঠিন সক্রিয় এই দল। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের পর কাতুকুতু দলের কর্মীরা আদা জল খেয়ে নেমেছে মাঠে।

এদের জ্বালায় পুরো জাতি অস্থির। দম মুখের কাছে চলে এসেছে। কী সাংঘাতিক কথা! ফেসবুক এবং ইউটিউবের মাধ্যমে দেশীয় এই বিশেষ দলটি পুরো জাতিকে খুবই হালকাভাবে অহর্নিশি কাতুকুতু দিয়ে যাচ্ছে। বগল তলায় দিচ্ছে, আবার বেজায়গায়ও দিচ্ছে। যারা এসবের নিয়মিত পাঠক কিংবা দর্শক তারা আজকাল শান্তিতে ঘুমুতেও পারে না। ঘুমের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠে। আতঙ্কে জেগে ওঠে। আতঙ্কবাদীরা কাজটি করে গুজব ছড়িয়ে। যত না সত্যের আশ্রয় নিয়ে করে, তার চেয়ে ঢের বেশি করে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে।

ফলশ্রুতিতে দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। এই আতঙ্ক ছড়াবার কৌশলের যেমনি কমতি নেই, বিষয়বস্তুরও তেমনি কোন অভাব নেই। এর মধ্যে একটি বিশেষ বিষয় হলো “নিষেধাজ্ঞা”। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রচারের ধরনটা এই রকম; আসিতেছে নিষেধাজ্ঞা। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা। র‌্যাব দিয়ে শুরু। সেনাবাহিনীও বাদ যাবে না। আসছে জাতিসংঘ; এবার ধরবে। শান্তি মিশনে আর যাওয়া লাগবে না। সরকারের প্রধানমন্ত্রীও আমেরিকায় নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছেন। রিজার্ভ শেষ। আসছে দুর্ভিক্ষ। দিনের অর্ধেক সময় লোডশেডিং আসছে। জ্বালানীর ভান্ডার শেষ। জ্বালানী কেনার টাকা নেই। বাংলাদেশ শ্রীলংকা হলো বলে।

এভাবেই চারিদিকে কাতুকুতুর মহড়া আর আহাজারীর মাতম চলছে। সাথে চলছে আহারে, উহুরে বলা। সবচেয়ে বেশি আহারে, উহুরে হচ্ছে শ্রীলংকা নিয়ে। বাংলাদেশ কেন এখনো শ্রীলংকা হচ্ছে না এই নিয়ে আহারে, উহুরের অন্ত নেই; আহারে, উহুরে! শ্রীলংকা কেন হয় না রে!! শুধু আক্ষেপ আর আক্ষেপ। আক্ষেপের কোন শেষ নেই। তবে কাতুকুতু দলের মূল আক্ষেপ একটাই; বাংলাদেশ এখনো কেন বিপদে পড়ছে না?

ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ব বড়ই বিপদে পড়েছে। পরিস্থিতি সাংঘাতিক ঘোলাটে হয়ে গেছে। তবে সামনে যতই ইউক্রেন রাশিয়া থাকুক, মূলত যুদ্ধ বাঁধিয়েছে আমেরিকা আর রাশিয়া। আর খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেন। শুধু ইউক্রেন নয়; খেসারত দিচ্ছে রাশিয়া আমেরিকা ব্যতিত পুরো বিশ্ব তথা বিশ্ববাসী। দেশে দেশে সরকার বদল হচ্ছে। পাকিস্তান, শ্রীলংকা তো চোখের সামনে। আরো বহু দেশ আছে। কমপক্ষে ৯৮টি দেশ রিজার্ভ সঙ্কটে পড়েছে। তারা আইএমএফ এর কাছে ডলার চেয়েছে। বিদ্যুৎ এর লোডশেডিং হচ্ছে জার্মানী, জাপান, অষ্ট্রেলিয়াসহ দেশে দেশে।

কিন্তু ব্যবসায়িক লাভ হয়েছে আমেরিকা রাশিয়ার। রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় উল্টো রাশিয়ার বাণিজ্য বেড়ে রিজার্ভ টইটুম্বুর হয়েছে। দাম বেড়েছে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের। আর বিশ্বব্যাপী রাশিয়া-চীন জুজুর ভয় দেখিয়ে অস্ত্র বিক্রি করে আমেরিকা লালে লাল। ইউরোপ আর এশিয়া প্যাসিফিকে অস্ত্র বিক্রি করে একাকার করে ফেলছে। তাই বলা বাহুল্য যে, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাস্তবিক অর্থে লাভ হয়েছে আমেরিকা এবং রাশিয়ার।

এবং দুর্ভোগে পড়েছে বাকি বিশ্ব। দুর্ভোগ থেকে বাংলাদেশও বাদ যায়নি। আর এটাকেই কাজে লাগানোর ধান্দায় নেমেছে ওরা। মোক্ষম সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে দেশের কাতুকুতু পার্টি বাংলাদেশের সর্বনাশ দেখার প্রত্যাশায় আছে। রোজ রাতে ওরা ঘুমুতে যায় ঘুমভাঙা সকালে দেশের সর্বনাশা খবর দেখার আশায়। আশায় আশায় নিত্যদিন বুক বাঁধে। বুকের মধ্যে থাকা মন খুব করে চায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতির কারণে সারাদেশ অন্ধকারে থাকুক। জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠুক আর ডুবুক সরকার।

সরকার ডুবুক তাতেই ওদের আনন্দ। দেশ ডোবায় কিচ্ছু যায় আসে না। বাংলাদেশ যখন কয়লা দিয়ে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নিল কাতুকুতু পার্টি মরিয়া হয়ে বাঁধা দিল। সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে দেবে না। অথচ সারা বিশ্ব এখন কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে মরিয়া হয়েছে। তেলের এই ক্রাইসিসে এছাড়া কোন উপায়ও নেই। কিন্তু সেদিন ষ্টুপিড এইসব জ্ঞানপাপীর দল ওসব মানতে চায়নি। পৃথিবী যে কখনো মহা ক্রাইসিসে পড়তে পারে সেটা ওদের জানা থাকলেও বিবেচনায় আনেনি। বিদেশী পয়সা খেয়ে সরকারের উন্নয়নে বাঁধাই দিয়ে গেছে কেবল। সরকারের করা উন্নয়ন যে দেশেরই উন্নয়ন, সেই বিবেচনাটুকুও করেনি।

করবে কি! বিবেচনা বোধ জ্ঞানপাপীদের থাকলে তো! জ্ঞানপাপীরা কোন কিছুতেই যখন সরকারের কিচ্ছু করতে পারে না, তখন আশ্রয় নেয় গুজবের। গুজবই এদের একমাত্র হাতিয়ার। এদের সকল কুকর্মের মূল অস্ত্র হলো গুজব। সেদিন উত্তরায় ধরা পড়া এটিএম বুথের হাইজ্যাকারকে বানাবার চেষ্টা করলো হিরো। প্রচার করা শুরু করলো অভাবের তাড়নায় সে হাইজ্যাকে নেমেছে। আর মানুষও সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করলো। অবাক হয়ে আমি বিশ্বাসী দলের কাউকে কাউকে জিজ্ঞস করলাম, সে নিজে হলে কী করতো? এমনি অভাবে পড়লে হাইজ্যাক করতো, নাকি রিকশা চালাতো?

কোন উত্তর নেই কারো। উত্তর দেবেটা কি? উত্তর দেবার সময়ই নেই ওদের। আছে এলার্জি। কাতুকুতু পার্টির কঠিন এলার্জি উন্নয়ন নামক শব্দের উপর। প্রথম প্রথম উন্নয়নের কথা শুনলেই বলতো, হাসিনা পারবে না উন্নয়ন করতে। উন্নয়ন দৃশ্যমান হওয়ায় এখন তারা ভোল পাল্টেছে। উন্নয়নের সফলতায় তারা কৌশলী কথা বলছে। বলছে, উন্নয়ন হলো বুঝলাম। কিন্তু দেশ তো শেষ। ঋণে ঋণে দেশের বারোটা বেজেছে। উন্নয়নের নামে চুরি করে সব তো খেয়ে ফেলেছে। অথচ ঋণের সব বোঝা জনগণের ঘাড়ে।

লক্ষ্য করুন, খালি কথা আর কথা। কত কথা যে জানে এরা। শুনলে মনে হয় সবই যৌক্তিক কথা। যুক্তি ছাড়া এদের কোন কথা নেই। যাই বলুক, যুক্তি থাকবেই। কঠিন যুক্তি। আগে বলতো, বিদেশী ঋণ না হলে হাসিনা পদ্মাসেতু করতে পারবে না। উদ্বোধন শেষে মুখ দেখানোর জো নেই। তাই নতুন সুর। নতুন সুরেই বলছে, সেতু তো করলো। এখন এত ঋণ শোধ করবে কেমন করে? জানি না, কোন একদিন ঋণ শোধ হয়ে গেলে কী বলবে!

তবে আমি নিশ্চিত, কিছু না কিছু বলবেই। শুধু নিশ্চিত না, সেই কথার ধরনটা কী হবে। অবশ্য আমার মত সাধারণ মানুষের পক্ষে এসব কিছু নিশ্চিত হওয়াও সম্ভব না। জানাও সম্ভব না। কাতুকুতু পার্টির মত চরম ভন্ড এবং চতুরদের কুটকৌশলের কথা আগেভাগে জানা কিংবা বোঝা মোটেও সম্ভব না। কোনকালেই না।
-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।