Home মতামত অর্ধেক মানুষ

অর্ধেক মানুষ

89

জিয়াউল হক মুক্তা:

আঙিনায় গাড়ির হর্ন বাজতে না বাজতে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ষাটোর্ধ ক্লিন-শেভড পরিপাটি একজন ভদ্রলোক। বোঝা যায় তিনি অপেক্ষা করছিলেন। তার পেছনে একজন তরুণ; অধোবনত, নির্দেশ পালনে প্রস্তুত; বোঝা যায় কর্মচারির মতো কেউ একজন।

সাধারণ কালো চপ্পল, স্কিন-টাইট কালো জিন্স, কালো পাঞ্জাবি আর কালো ওড়না পরিহিতা মৌটুসি নামলেন ড্রাইভিং সিট থেকে। কালো রোদ-চশমা কপালে তোলা, চুল আগোছালো। দেহসৌষ্ঠব ব্যকরণসম্মত; আদর্শ পরিমিতির কনটেমপোরারি ক্ল্যাসিক। মুখশ্রী দেখে সতের বছরের একজন মনে হলেও তার বয়স সাতাশ।

— জ্যামে পড়িনি, জেঠা। যখন আসবো ভেবেছিলাম তার আগেই চলে এলাম।
— তাই তো দেখছি! আসলে একটু পরিকল্পনা মাফিক চলাফেরা করতে পারলে অনায়াসে আমাদের দেশে মহাসড়কের ভোগান্তি এড়ানো যায়। হেভি ট্র্যাফিক তো ইউনিভার্স্যাল ইস্যু!

জেঠা, মানে পরিপাটি ভদ্রলোক, রফিকুল হক; মৌটুসির বাবা শফিকুল হকের বড় ভাই। বিভিন্ন জেলা শহরে সমাজবিজ্ঞান পড়িয়ে কয়েক বছর হলো অবসর নিয়েছেন। তার দুই ছেলে ইউরোপে অভিবাসী হয়েছেন; নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের বাকিটা তিনি সস্ত্রীক গ্রামীণ আবহের এ মফস্বল পৈত্রিক শহরে কাটাতে চান।

— ঘরে চলো, মা। ফ্রেশ হয়ে নাও।
— জ্বি, জেঠা।
— সোবহান, ব্যাগগুলো ভেতরে নিয়ে আসো।

মোটুসি সোবহানের দিকে তাকালেন; আট বছর পর। সোবহান অধোবনত। জেঠার সাথে মৌটুসি ভেতরে চলে গেলেন। সোবহান গেলেন গাড়ির দিকে।

সুঠাম ও অসম্ভব মিষ্টি চেহারার শ্যামলা সোবহান বছর পাঁচেক হলো রফিক ও তাঁর স্ত্রীর দেখভাল করেন। তাঁরা তাকে ছেলের মতো স্নেহ করেন; চমৎকার একটি ঘর দিয়েছেন। তার বয়স সাতাশ। বিষয়সম্পদের দেখাশোনা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না— সবকিছুতে সে তাদের সহকারী। এসবের কোনোকিছু মৌটুসীর অজানা নয়। আট বছর আগে শফিকুল হক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়সম্পত্তি বিক্রি করে রাজধানীতে স্থায়ী নিবাস গড়ার আগ পর্যন্ত এ মফস্বল শহরে মৌটুসি ও সোবহান সতীর্থ ছিলেন।

মৌটুসি জানেন আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সোবহানের আর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়া হয়ে ওঠেনি। সোবহান জানেন উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মৌটুসি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। মৌটুসি জানেন সোবহান বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু বৌ চলে গিয়েছেন, কেন তা কেউ জানেন না। সোবহান জানেন মৌটুসি একজন দেশীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী পেশাজীবিকে বিয়ে করেছেন, তাদের তিন বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান আছে। মৌটুসি জানেন তার একদা সহপাঠি সোবহান এখন তার জেঠা-জেঠির দেখাশোনা করেন। সোবহান জানেন মৌটুসি পনের দিনের জন্য দেশে এসেছেন; একা; দু’দিন বরাদ্দ করেছেন জেঠা-জেঠির জন্য।

সোনালী সন্ধ্যায় মৌটুসি গল্প করছেন জেঠা-জেঠির সাথে। লং ড্রাইভের পর লম্বা গোসল, তৃপ্তিদায়ক খাবার আর ক্লান্তিহরা ঘুমের পরে তার গাল লাল আর ফোলা ফোলা আদুরে হয়ে আছে; হেমন্ত-সন্ধ্যার সোনালী আলোয় তাকে অবর্ণনীয় রমনীয় দেখাচ্ছে। তাদের চা-নাস্তা সার্ভ করছেন সোবহান। চায়ে চুমুক দিয়ে মৌটুসি বললেন, চা তো বেশ ভালো বানিয়েছিস সোবহান! অধোবদন সোবহান নিরুত্তর। মৌটুসি আবার বললেন, প্রশংসা করলে ধন্যবাদ দিতে হয়, এটা জানিস না সোবহান? বিব্রতভাবে হাসলেন সোবহান; দু’হাত কচলাতে লাগলেন। মৌটুসি জিজ্ঞেস করলেন, কী?

চা আমি ভালো বানাইনি আপা, চা-পাতা ভালো ছিল, জেঠা আপনার পছন্দ জানেন— সোবহান জবাব দিলেন মৃদুস্বরে।

— চা-পাতা বেহেশত থেকে আসুক, আই ডোন্ট কেয়ার। কেউ চা তৈরি করে দিলে তাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হয়— এটাই ভদ্রতা। বিনিময়ে তারও একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য। এসব তুই ভুলে গেলি কী করে?
— ভুল হয়ে গেছে আপা।
— ঠিক আছে, যা। পরে কথা হবে।
— আচ্ছা আপা।

সোবহান চলে যাবার পর জেঠি মৃদুস্বরে বললেন—
— কিছু মনে কোরো না মা। ও তোমার সহপাঠি ছিল, এখন তোমাকে সার্ভ করছে, কিছুটা বিব্রত থাকা স্বাভাবিক। এমনিতে ও খুব সাবলিল, খুব ভালো ছেলে।
— সেটা অবশ্য বুঝতে পারি।

জেঠা যোগ করলেন—
— এর একটা শ্রেণিগত ব্যাপারও রয়েছে।
— জ্বি।
— ভোরে বাগান দেখতে বেরুলে তুমি বরং ওকেই সাথে নিও; আমার ধারণা ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে; সামান্য সময় পেলেই হলো। আমরা বরং নাস্তার সময় কথা বলবো।
— আচ্ছা জেঠা। আপনি ওকে বলে রাখলে ভালো।

প্রসঙ্গ পাল্টালেন মৌটুসি। মৃদুকণ্ঠে বললেন, বাসায় এতো করবী গাছ! লাল, গোলাপি! করবী আপনাদের খুব পছন্দ, তাইনা?

জেঠি জবাব দিলেন, আরে না! এসব সোবহানের কাজ। করবীর ব্যাপারে এই শান্তশিষ্ট ছেলেটির মধ্যে একটা আশ্চর্য উন্মাদনা কাজ করে। গাছ লাগাবে, যত্নআত্তি করবে। শরৎ-হেমন্ত এলে তো কথাই নেই। ফুলগুলো নিয়ে ওর কী যে কাণ্ডকারখানা!

সকাল-ভোরে গাছের ডালগুলো কাছে টেনে কেমন মাতালের মতো ফুলগুলো শোঁকে— বলেই হো হো করে হেসে ওঠলেন জেঠা।

জেঠি যোগ করলেন, শরতে বৃষ্টিচ্ছটা বা হেমন্তে সামান্য-কুয়াশা লাগা ফুলগুলো দেখে ওর যেন আশ মেটেনা।

মৌটুসি হাসলেন নিঃশব্দে। একটু বিব্রত যেন।

ডিনারের সময় মৌটুসি বললেন, ছোট মাছের চচ্চড়িটা দারুণ হয়েছে রে সোবহান! সোবহান রোবোটের মতো করে বললেন, ধন্যবাদ আপা। মোটুসি ফিক করে হেসে ফেললেন, মুখের খাবার কিছু ছিটকে গেল চারদিকে, তালুতেও ঠেকেছে। কাশতে লাগলেন। সে এক বিদিকিচ্ছিরি ব্যাপার! জেঠি ওর মাথায় হালকা চাপর দিতে লাগলেন, জেঠা পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলেন। সোবহান উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে রইলেন, বুঝতে পারছেন না কেন এমন হলো।

অল্পক্ষণে মৌটুসি স্বভাবিক হলেন; কাশির দমকে মুখাবয়ব লাল হয়ে আছে কিন্তু চোখে-ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। জেঠা-জেঠিও হাসছেন এখন। মৌটুসি সোবহানকে বললেন, তুই পারিসও বটে! সোবহান চোখে একটি প্রশ্ন ধরে তাকালেন মৌটুসির দিকে; আট বছর বিরতির পর এবারে প্রথমবারের মতো। মৌটুসিও হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। জেঠার বাক্য সে ক্ষণ প্রলম্বিত হতে দিল না— সোবহান, আপাকে সকালে বাগান দেখাতে নিয়ে যাস।

পুকুর পাড় ধরে হেমন্ত-সকালে মৌটুসি হাঁটছেন এমন মৃদু যেন ঘাসের শিশির না ঝরে। কালো চপ্পলের সাথে কলাপাতা সালোয়ার আর ঢিলেঢালা গোলাপি টি-শার্ট। সোবহান হাঁটছেন এক কদম পেছনে; চপ্পল পায়ে, কিন্তু পরিপাটি। চার দিক দেখতে দেখতে মৌটুসি স্বগতোক্তি করছেন, শৈশব-কৈশোর-সহপাঠি-পথঘাট ইত্যাদি কতো কথার কথকতা! সোবহান শুনছেন, প্রয়োজনে হুঁ-হ্যাঁ, জ্বি আপা, হ্যাঁ আপা করছেন।

পুকুর পেরিয়ে, আম গাছ আর জাম গাছ ছাড়িয়ে, বিশাল কদম গাছটির কাছে এসে মৌটুসি বললেন, আর এখানে, এখানে এ রকম এক সকালে আমি তোকে জোর করেছিলাম। কী যে ভয় পেয়েছিলি তুই! কবুতরের বাচ্চার মতো কাঁপছিলি। আমার দয়া হয়নি মোটে, ইচ্ছেটা লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছিল, শরীর জ্বালা করছিল। নাও আই নো হোয়াট আই মেইড ওয়জ ইন কাউগার্ল স্টাইল। দ্যাট ওয়জন্ট লভ বাট এ কাইন্ড অব আর্জ। ফিজিক্যাল। তখনও আমার আঠারো পুরো হয়নি। আমরা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।

ওসব বাদ দেন না আপা— সোবহানের কণ্ঠে উদ্বেগ।

কিন্তু দ্বিতীয় বার থেকে তুই শালা কুত্তা হয়ে গেলি। কতো রকমের কাণ্ড যে করতি! কী অদ্ভুত ভালো যে লাগতো যখন আমার তুই গন্ধে শ্বাস নিতি। বলতি, আমার শরীর নাকি করবী! মাঝে মাঝে রক্তজমাট ঠোঁট নিয়ে কতো যে মিথ্যা জবাবদিহি করতে হয়েছে! কপাল ভালো পেট বাধিয়ে দিসনি!

প্লিজ আপা, দু’হাতে কান চেপে সোবহানের কাতর মিনতি, আমাকে রেহাই দিন, প্লিজ!

এ্যাই শালা চুতিয়া, কী বালের আপা আপা করছিস কাল থেকে… বলে ঝট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে সোবহানের বুকের কাছে বুক প্রায় ঠেকিয়ে চোখে চোখ রেখে রাগতভাবে তাকালেন মৌটুসি। তার টি-শার্টের গলা বাঁ দিকে বেশ খানিকটা সরে গেছে, নেমে এসেছে বাহুমূল থেকে খানিকটা নিচে, কাঁধে চেপে বসা কালো ব্রা’র স্ট্র্যাপ দেখা যাচ্ছে পুরোটা। মৌটুসি বলে যাচ্ছেন, দ্যাখ একখান বাচ্চা বিইয়ে কেমন ডবকা-ডাসা হয়েছি এখন।

আবারও করবী-গন্ধে সোবহানের সমীহদৃষ্টি আপ্লুত হলো আচ্ছন্নতায়; তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠলেন, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। তার মধ্যে আকাঙ্ক্ষার জোয়ার ফুলে ওঠতে চাইলো।

কিছুক্ষণ পর সন্ত্রস্ত সোবহানকে ছেড়ে দিলেন মৌটুসি। বললেন, ভয় পাসনে, আমি তোর উপর চড়ে বসছিনা। স্মৃতিচারণ করছি কেবল। এতে তোর কোনো সমস্যা আছে?

সোবহান সামান্য পিছিয়ে দাঁড়ালেন। ঢোক গিলে বললেন, আমি আপনার জেঠার কর্মচারি; চাকরিটি আমাকে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, মা’র ওষুধ কিনছি, ছোট বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। আপনার প্রতি আমার দৃষ্টির বা আচরণের কোন বিচ্যুতি আমার পরিবারের জন্য ভালো হবে না।

মৌটুসির রাগ কমে এল। তিনি বুঝতে পেরেছেন এসব অহেতুক। আচ্ছা চল— বলে তিনি নিজে কিছুটা ধীর হয়ে সোবহানের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন। চুপচাপ। একবার কেবল খুব কোমল করে বললেন, আমরা তো বন্ধুও বটে! তাইনা? সোবহান নিরুত্তর।

ফেরার পথে তারা বসলেন সে কদম গাছের তলায়।

— সোবহান?
— জ্বি!
— জেঠি তোকে দেখেশুনে বিয়ে দিলেন। এক বছরও সংসার করতে পারলি না। কেউ জানেনা মেয়েটি কেন চলে গেল। তুই আসলে বলছিস না কেন এমন অমন হলো। তাই না?
— হুঁ।
— কী হয়েছে অন্তত আমাকে বল। আমি কাউকে বলবো না। যেমনটি তুই আমাকে নিয়ে কাউকে কিছু বলিসনি।
— স্বপ্না খুব ভালো মেয়ে। আমাকে ভালোবাসতো। আমিও। আমি বুঝতে পারিনি আমাদের পরম ক্ষণে আমি একদিন ওকে তোর নাম ধরে ডেকে গুঙিয়ে ওঠেছিলাম। পরদিন সকালে ও বিষয়টি পাড়লো। এটাসেটা বলে ব্যাপারটি আমি হালকা করে দিলাম। কিন্তু অনেক সাবধান থাকার পরও বারবার এমন হতে লাগলো। ও ভাবলো আমি ওকে ভালোবাসিনা, ভালোবাসি মৌটুসি নামের একজনকে। প্রখর আত্মসম্মানের কারণে ও অপমানিত বোধ করলো। চলে যাবার আগে ধীরস্থিরভাবে বুঝিয়ে বলে গেল যে অর্ধেক মানুষের সাথে তার বসবাস করা উচিত না, আমার শরীর নাকি ওর কাছে আর হৃদয় মৌটুসি নামের কারো কাছে।

সোবহান বললেন আকাশে তাকিয়ে। তার চোখ আর্দ্র, কণ্ঠ গাঢ়, হৃদয় শূন্য।

মৌটুসি বসে রইলেন অধোবনত। গ্লানির কষ্ট তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অতীতে তিনি কারোর সামনে এভাবে নতজানু হননি।

২৫ আগস্ট ২০২২; নিভৃতি।

-লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক, লড়াই।