Home জাতীয় অপপ্রয়োগ সরকারের জন্য বিব্রতকর, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্রুত সংশোধনের তাগিদ

অপপ্রয়োগ সরকারের জন্য বিব্রতকর, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দ্রুত সংশোধনের তাগিদ

43

সৈয়দ আমিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি : প্রকৃত সাইবার অপরাধের তুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তথ্য ও মতামত প্রকাশ সম্পর্কিত ধারাগুলোতে বেশি মামলা হচ্ছে। গণমাধ্যম উন্নয়ন সংগঠন সমষ্টির গবেষণা প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে (২৪ ফেব্রুয়ারি) গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে আলোচকরা জানান, এ আইনে দায়ের করা অনেক মামলায় অভিযোগ গঠনের মতো উপাদান না থাকায় সেগুলো খারিজ হয়ে যাচ্ছে। আইনটির ব্যাপক অপপ্রয়োগ সরকারের জন্য বিব্রতকর বলে মন্তব্য করে দ্রুত এ আইনের পর্যালোচনা ও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন আইনপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা।
সাংবাদিকতার ও নীতি-কাঠামো পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ করণীয় বিষয়ে এ আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন জেষ্ঠ্য সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল। প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি।
আলোচনায় অংশ নেন সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান, অধ্যাপক ড. মফিজুর রহমান, অধ্যাপক ড. হাফিজুর রহামন কার্জন এবং বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনের নেতাসহ বিশিষ্ট সাংবাদিকরা। গবেষণা প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন সমষ্টি’র গবেষণা পরিচালক রেজাউল হক।
স্বাগত বক্তৃতা করেন সংগঠনের পরিচালক সাংবাদিক মীর মাসরুর জামান ও মীর সাহিদুল আলম।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলে সেগুলো বিশেষ বিবেচনায় দেখার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি অন্য নাগরিকদের জন্য বৈষম্যমূলক বলে মন্তব্য করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হাসানুল হক বলেন, অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার ও অফিসিয়াল সিক্রেটস্ অ্যাক্ট বাতিল করা উচিত। প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট হালনাগাদ করে কার্যকর করারও আহবান জানান তিনি।
হাসানুল হক ইনু বলেন, গণমাধ্যমকর্মী আইন ও সম্প্রচার আইন দীর্ঘদিন ধরে খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো দ্রুত পাশ করা হলে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা আরো সুরক্ষা পাবে। সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করে সাবেক এই তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে দেশের সাংবাদিকতার গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বার্ষিক রিপোর্ট প্রণয়নের আহবান জানান।
তিনি বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট সরকারকে নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করবে।
সমষ্টি’র গবেষণায়, সাংবাদিকতার উন্নয়নগত দিক, প্রভাবক উপাদান এবং নীতি-কাঠামোর প্রবণতাগুলো তুলে ধরা হয়। দলীয় আলোচনা, মতামত জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে।
এতে দেখা যায়, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪৬১ জন সাংবাদিকের ৭৯ শতাংশ মনে করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্বাধীন সাংবাদিকতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
উত্তরদাতা সাংবাদিকদের ৯৪% সাংবাদিক আইনটি সংস্কার অথবা রহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁদের ৬৫% মনে করেন আইনটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তথ্য ও মতামত প্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য নেতিবাচক উপাদানগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনমাফিক সংস্কার করা প্রয়োজন, অন্যদিকে ২৯% সাংবাদিক আইনটি সম্পূর্ণ বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারী সাংবাদিকরা সংসদ সদস্য, সাংবাদিক সংগঠন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ নিয়ে উদ্যোগ নিতে পারে বলে মনে করেন।
গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংবাদ প্রতিবেদন থেকে ২৫০টি মামলার তথ্যে দেখা যায়, মাত্র ১৮% মামলায় সাইবার অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে। বাকি ৮২% মামলায় অনলাইন মাধ্যম বা সংবাদপত্রে তথ্য বা মতামত প্রকাশের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আনা হয়েছে। তথ্য ও মতামত প্রকাশ সংক্রান্ত মামলাগুলোতে বেশি অভিযোগ আনা হয়েছে ২৫ ধারায় (৪৮%)। পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে ২৮ ও ২৯ ধারা (যথাক্রমে ১৭.৩১% ও ১২.১৮%)। এছাড়া বহুল ব্যবহৃত অন্য দুটি ধারাগুলো হচ্ছে ২৯ ও ৩১। রাজনীতিক বা রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারা ৪৬% মামলা করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ২৩% মামলায় বাদী হয়েছেন।
অন্যান্য বাদী ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন, সাংবাদিক, আইনজীবী, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, বেসরকারি চাকরিজীবী, ধর্মীয় নেতা, মুক্তিযোদ্ধা ও বিচারক। মামলাগুলোতে ২০ জন নারীসহ অন্তত ৫৫৪ জনকে আসামি করা হয়। ১৫৩টি মামলায় প্রধান আসামিসহ একাধিক আসামিকে মামলার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয়। মামলার বিবাদীদের মধ্যে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি ৩৬%, সাংবাদিক ২৯%, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ১৪%। বাকিরা ছিলেন বেসরকারি চাকুরে, ধর্মীয় নেতা, ব্যবসায়ী, শিল্পী, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারী। অর্থাৎ মোট মামলার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মামলায় সাংবাদিকরা অভিযুক্ত হয়েছেন।
সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমানও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের তাগিদ দেন। রাজনীতিকসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সাংবাদিকসহ আরো বেশি আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।

আলোচকরা বলেন, মতপ্রকাশের আন্তর্জাতিক মানদন্ডের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ আইনের অপপ্রয়োগ সরকারকে অনেকসময় বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে। অনেক সময় মামলায় সত্যতা থাকে না। তাঁরা সাংবাদিকদেরর দক্ষতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য সমন্বিত, আধুনিক ও বিকেন্দ্রীকৃত উদ্যোগ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দেন। তাঁরা বলেন, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো এ জায়গায় আরো কাজ করতে পারে; গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কাঠামো আরো শক্তিশালী হওয়া উচিত, সেই সঙ্গে স্বচ্ছতার দিকটিও উন্নত করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগগুলো গণমাধ্যমের সার্বিক পরিবেশকে আরো উন্নত করবে বলেও মন্তব্য করেন আলোচকরা। আইনপ্রণেতারা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য আইনের সংস্কারের বিষয়টি সংসদে তুলে ধরবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।