Home সাহিত্য ও বিনোদন অনুগল্প: তাহার নাম ফুলপরী

অনুগল্প: তাহার নাম ফুলপরী

65

পলাশ কলি হোসেন শোভা: মোবাইলটা একটানা বেজেই চলেছে। মহা বিরক্ত আতিক, ঘুমের মধ্যেই ফোনটা রিসিভ করে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোন কথাই ঠিকমত বুঝতে পারছে না। পরে কল দিচ্ছি বলে লাইনটা কেটে দিয়ে পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। পাশে নীতু গভীর ঘুমে বিভোর।

বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো নীতুর। নিজেকে ভীষন অপরাধী লাগছে তার, কি করে ফজরের নামাজটা কাজা হয়ে গেলো? মনটা বিষন্ন হয়ে পড়ে।
গত একমাস ধরে দেশে এসেছে। আতিকের বিজনেস মালোশিয়াতেই। মাঝে মাঝে এসে থাকে। দেশের প্রতি দুজনেরই দারুণ টান।
ডাইনিং এ চা খেতে খেতে নীতু বললো, এ্যাই অত রাতে কে ফোন দিয়েছিলো?ঘুমের ভেতর মনে হয় রিং বাজলো।
আতিক মনে করতে পারেনা, কললিস্ট দেখে বললো,
আরে ওয়াং কল দিসে, কেন?
কল ব্যাক করতেই শুনতে পেলো আধা বাংলা আধো ইংরেজিতে বলছে,

তুমি বাসায় কাকে রেখে গেছো, সারারাত কল ছেড়ে রাখে। রান্না করে, ডিশ ওয়াশ করে শব্দ করে। তোর নেইবার ইন্ডিয়ানটা কমপ্লেন করেই যাচ্ছে।
না তো বাসা তো লক, কেউ নেই।আচ্ছা আমি তোমাকে পরে কল দিচ্ছি।

নীতু ওয়াং এসব কি বলছে? নীতু সব কথাই শুনেছে কারণ আতিক অলওয়েজ স্পীকারে কথা বলে।
তুমি তো পরে দেশে এসেছো, ভুলে কি কল ছেড়ে আসছো?
ধুরু কি যে কও। আমি সব চেক করে আসছি। গেটের চাবি তো রহিম কে দিয়ে আসছি টব গুলো তে পানি দেবার জন্য ।
রহিমকে ফোন দাও, চেক করতে বলো। আর ডিশ ওয়াশ কে করবে রাত – দুপুরে?সমস্যা নেই আমরা তো দুদিন পর যাচ্ছি।

মালোশিয়ায় সকালের ফ্লাইটেই চলে আসে নীতুরা। ঘরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে যায়, সারাবাড়ি অগোছালো চেয়ার টেবিল জিনিসপত্র কোনটাই জায়গা মত নেই। নীতু বেশ বিরক্ত হয়ে রহিমের দিকে তাকাতেই রহিম বুঝতে পারে মামী তাকেই আসামী করছে,
আমি তো শুধু বারান্দায় গিয়ে পানি দিয়ে চলে আসি তিনদিন আগেও সব ঠিক ছিলো। বুঝলাম না মামী কেমনে কি?
বিস্ময় বোধ করে সবাই।

সংসারের কাজে লেগে পড়ে নীতু। কিচেনে ঢুকে আরেকটা ধাক্কা খায়, টেবিলে এত প্লেট ডিশ কে রাখলো? এসব তো ডিনারওয়াগানে ছিলো!! ভুতের আছর পড়লো কি? আতিক কে দেখাতে সে ভয় পেয়ে গেলো। তাহলে কি এখানেও ওরা চলে এলো?
এই কি বলছো বিড়বিড় করে বলোতো?
কিছু না, আচ্ছা দেখি কি হয়, আমরা তো চলে এসেছি।
চিকেন রান্না করার জন্য প্যানে তেল আর পিয়াজ দিয়ে খুন্তিটা নিতে পিছন ফিরে খুঁজতে থাকে নীতু ওটা তো জায়গা মত নেই। যাক্ পাওয়া গেলো। মশলা দেবার জন্য পটে হাত দিয়েছে দেখে তেলের ভেতর সব মশলা দেয়া হয়ে গেছে। ভীষণ রকম চমকে যায় নীতু, এটা কি করে সম্ভব?

নীতু জানতো আতিক কে অনেক বছর আগে জ্বীন ধরেছিলো তা এই বাসায় কেন? যদিও নীতুর জ্বীন ভুত পেত্নী কিছুতেই বিশ্বাস ছিলো না। পরে বিশ্বাস করেছে কারণ আমাদের ধর্মে বলা আছে আল্লাহ্ জ্বীন ও ইনসান সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। মানুষের মধ্যে যেমন ভালো মন্দ আছে তেমনি জ্বীনদের ভেতরেও আছে। নীতু ভয় পায়না কারন ও নামাজ দোয়া কালামের মধ্যেই থাকে।
হ্যালো তুমি কি আছো? আমাকে জ্বালাচ্ছো কেন চলে যাও আমার বাসা থেকে। একা একাই কথা গুলো বললো নীতু। জানে কোন সাড়া আসবে না তবুও

রান্না শেষ করে বেড রুমে ঢুকতে যাবে দেখতে পেলো আতিক খুব হাসছে আর কি যেন বলছে সামনে এক থোকা আঙুর। থমকে যায় নীতু
বেশ জাকিয়ে বসেছে তো।
এ্যাই কার সাথে হাসছো? আঙুর পেলে কোথায়? বাসায় তো কোন ফল নেই!
আতিক চুপসে যায়। নীতু ও এসেছিলো আমাকে আঙুুর খাওয়াচ্ছে , তোমাকে ও সহ্য করতে পারেনা। তাই হাসছি।
ও টা কে? তোমার সেই ফুলপরী?
হু, এখানেও চলে আসছে।

দশ বছর আগে যশোরে বড় ভাইয়ের বাসার সামনে থেকে সন্ধ্যার সময় আতিক কে ধরেছিলো পরী ফুলপরী। অনেক হুজুর কবিরাজও পারেনি ফুলপরীর আছর থেকে আতিক কে মুক্ত করতে। বিয়ের আটমাস চলছে নীতুর। একমাসের মাথায় নীতু বুঝতে পারে আতিকের সাথে জ্বীনপরী আছে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ওরা দিন পার করে দেয়। রাতে ঘুমানোর আগে নীতু বলে,
শোনো বাবু সারাবাড়ির লাইট জ্বেলে রাখবো, তাহলে আর আসবে না।

কি যে বলো তুমি, দিনের বেলায়ই ঘুরছে আর রাত।
রাত দশটা বাজতেই দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। শেষ রাতে তিনটার দিকে নীতু উঠে পড়ে তাহাজ্জুদ এর জন্য । রাতে রুমে পানির বোতল আনতে ভুলে গিয়েছিলো। ডাইনিং এ যাবার জন্য দরজা খুলতেই দেখে সারা বাড়ি ঘুটঘুটে অন্ধকার।সব সময় বাইরের আলোতে আবছা আলো থাকে আজ তাও নেই।
বাবু এই বাবু ওঠো
আতিকের ঘুম ভেঙে যায়। কি হইছে মনি?
তুমি লাইট জ্বালাওনি? তোমাকে না বলেছিলাম আলো করে রাখতে
আরে আমি সব লাইট দিসি এমনকি কোনার রুমটারও লাইট দিসি।
দুজনেই ডাইনিং এর লাইট দিতে চমকে যায়,আরে চারটা চেয়ার কই গেলো?

লিভিং রুমের সেন্টার টেবিলের চার পাশে চেয়ার গুলো রাখা আর টেবিলে রাখা আছে কয়েক পারা কোরআন শরীফের খন্ড। নীতু হাতে নিয়ে দেখে ২৬ পারা থেকে ৩০ পারা। যা নীতুর সংগ্রহে আছে। নীতু অবাক হয়ে বলে, তোমার ফুলপরী দেখি পরহেজগার। বাবু কপাল তো তোমার খুব ই ভালো ঘরওয়ালি বাহারওয়ালি দুজনেই…..
আতিকের গলা শুকিয়ে যায়।
মনি পানি খবো। ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে কেমন যেন ভয় পেতে থাকে।

সকাল হতেই কোতায়ারার মসজিদ থেকে হুজুর কে আনা হয় সাথে আরও কয়েকজন পরিচিত বাঙালি বন্ধুরা ও এসেছে।
হুজুরের দেশ চাঁদপুর অনেক বছর ধরে এখানকার মসজিদে ইমামতি করেন।সকলের আস্হা ওনার উপরে আজ ফুলপরী বিদায় হবেই হবে।

হুজুর দোয়া কালাম পড়ে শুরু করলো দরজার আড়াল থেকে নীতু গভীর মনোযোগে দেখতে থাকে
ওই তুই কইথিকা আইসোস? এহানে কি চাস? নাম

কি তোর? কার কাছে থাকোস?
যে ছেলেটির উপর ভর করিয়ছে, সে বললো, আতিক তো আমারে চিনে কত কালের ভালবাসা আমাদের ঐ মাইয়া আইসা সব শেষ করছে। ভাবছিলাম আর ওর কাছে আসবো না কিন্তু ওরে আমি এত ভালবাসি যামু না আর। তুইও ছাড়াইতে পারবি না মোল্লা।
চুপ কর বেয়াদব। নাম কি তোর।
তুই জানোস না ক্যান? আতিক তো জানে, ফুলপরী।
কতজন তোরা এইখানে? কতদিনধইরা আছোস?
মা বাবা দুই ভাই চাচা দাদীফুফু আছি, পঁচিশ দিন ধইরা যামু না।

চৌদ্দ গুষ্টি লইয়া আইছোস খাড়া বলেই হুজুর সুরা ইয়াসীন আয়াতুল কুরসী পড়তে লাগলো। আর নীতু দেখছে আতিকের চেহারা বিদঘুটে আকার হচ্ছে আর চিৎকার করছে। এক সময় অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসলে হুজুর বলেন, ওদের ভেতরও আল্লাহ্ র কালাম আছে তাড়ানো কঠিন। তবে বড় মসজিদ এর ইমাম সাহেব কে নিয়ে আসবো। উনি ইনশাআল্লাহ ব্যবস্হা নিবেন।

দিন যায় সময় যায়। নীতু আতিক কে চোখে চোখে রাখে, ইদানীং নীতু ঘুমালেই ফুলপরী বিছানায়ও চলে আসে। বলে, তুমি বউটারে ছেড়ে দাও। আমি তো ওরে কিছুই করতে পারবো না ওর কাছে শক্ত ইবাদত আল্লাহর কালাম আছে নইলে আমি ওরে গলা টিপে মারতাম।

ফুলপরী তুমি বউ এর কোন ক্ষতি করবা না বলো?
তাহলে তুমি আমার সাথে সব করবা আমি যা যা চাই। তইলে ওর কিছু করবো না।
আতিক মনে মনে ভাবে এটাই মেনে নেই অন্তত বউটা তো বাঁচুক।আমার ভালবাসা আমার প্রেম।
সারাদিন কাজ করে নীতু, ফুলপরী মহা বিরক্ত করে রান্নার সময় কখনো লবন দিয়ে তরকারি অখাদ্য করে দেয় কখনো মরিচ দিয়ে ঝাল করে দেয়।
রাতে শুয়ে শুয়ে নীতু ভাবে, আর কয়টা দিন পরেই বড় হুজুর এলে ফুলপরীরে ঝেটিয়ে বিদায় করবে। বাবুকে সে একান্তে নিজের করে পাবে।থাকবে না কোন ভাগীদার।

-লেখক : অধ‍্যাপক (অব) মীরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।