Home সাহিত্য ও বিনোদন অনুগল্প: একটি শতবর্ষী তাল গাছের আত্মকাহিনী

অনুগল্প: একটি শতবর্ষী তাল গাছের আত্মকাহিনী

51

মোঃ হাবিবুল্লাহ: আমার পরিচয়, আমি একটি শতবর্ষী গাছ, শিল্পের পাখি বাবুই, নিরাপদ আশ্রয় জেনেই উঁচুতে, আমার ডানায় বাসা বেঁধে নিরাপদ বোধ করে। ফুল-ফল, পত্রপল্লব, মূল-কান্ড, সবই আছে আমার, কিন্তু অন্য সব গাছের মত ঋতু পরিবর্তনে-আমার শক্ত ডানাগুলো সহজে ঝরে পড়ে না।

আমিও সবার মত প্রকৃতির সৃষ্টি, একটি সৌন্দর্য্য বর্ধন গাছ, কাল বৈশাখীর ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, হেরিকেন আমার মূল উৎপাটনের চেষ্টা করে , কিন্তু পারেনা, কোনদিন পারবেও না, কারণ…আমি বাঙালির হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, হৃদয় গভীরে ধারণ করে আসছি। কত অজানা করুণ ইতিহাসের সাক্ষী আমি। আমাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে অনেক আত্মত্যাগ হয়েছে।

তবে প্রকৃতিসৃষ্ট বজ্রপাতের মত অনেক বড় বড় বিপদ আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে প্রতিনিয়ত নেমে আসে। এগুলো তোমাদের উপর আসার আগেই আমার উপর আগে পড়ে। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে বজ্রটাকে মাথায় ধারণ করে মাটির গভীরে পৌঁছে দেই। যখন সেটি সহ্য করতে পারি, অগ্নিতাপে পুড়ে গিয়ে আমার মৃত্যুঘটে। আমরা রাস্তার দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু গ্রামীণ মেঠো পথের সৌন্দর্য্যবর্ধন করিনা, নিজের জীবন উৎসর্গ করে তোমাদের হঠাৎ বজ্রপাতের বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখি। তাই তোমরা মাঠেঘাঠে রাস্তার ধারে আমাকে রূপণ করে বজ্রপাতে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পেতে পারো।

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাকে চিরন্তন দৃঢ়চিত্তে, একপায়ে দাডিঁয়ে থাকতে দেখেন, তাই কবি আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেন, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁডিয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে’…।
কবি আমাকে বুঝেছেন, আমার প্রকৃতি জেনেছেন, আমার রূপ সৌন্দর্য্য হৃদয়ে ধারণ করে রচনা করেছেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’…। রাখালেরা আমার পাতায় বানানো বাঁশি বাজিয়ে বাংলার আকাশে বাতাসে মনকাড়া সুরের ঢেউ তুলে, আমাদের হৃদয়ের কোণে সেই সুর যেনো বেজেই চলে। আজো বাংলার ঘরে ঘরে, গরম যন্ত্রনায় নিস্তার পেতে, আমার পাতায় বানানো হাত পাখা নেড়ে নেড়ে গা শীতল করে।

বাহ্যিক চোখে আমাকে মনে হয়, এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছি, অনুভুতির চোখে আমি…কোটি বাঙালির একতার বল একসাথে জড়িয়ে, আমার মূলের সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে। তাই আমি যুগ যুগান্তরের শত ঝড় ঝঞ্ঝায়, দুর্গম হাজারো বাঁধা পেরিয়ে সগৌরবে মাথা উচুঁ করে তোমাদের মাঝে কালের স্বাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। জন্মেছি স্বাধীন বাংলাদেশের উর্বর মাটি ফুঁরে, আমি জেগে উঠি বাংলার মানচিত্রের বুক চিরে, আমার মূল, শিকড় গেঁথে আছে বাঙালির গভীর অন্তরে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর মুক্তির ডাকে সাড়া দিয়ে, লাখো বীর বাঙালি অস্ত্র ধরে।

আমি এমনই একটি গাছ, শত চেষ্টা করেও আমাকে পারবে না উপড়ে ফেলতে। আমি সেই মহান আত্মত্যাগের ফসল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ জয়ে সবার চোখে ছিল আনন্দের জল, আমি যে এখন পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একটি গাছ, আমার শিকড় বাকড় পৌঁছে গেছে সে পর্যন্ত, যেখানে মহান শহীদের তাজা রক্তে স্নাত মাটি,স্বাধীন বাংলাদেশে রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত এ পবিত্র মাটি চুমুকে চুমুকে যতদুর গভীরে নিয়ে ছিল। সে রক্ত আজো শুকায়নি, মাটির স্তরের ভাঁজে ভাঁজে নিরাপদ ঠাঁই নিয়েছে। জীবন্ত হয়ে ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হয়ে আছে, থাকবে যুগযুগ নিরন্তর।

আমাকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা হবে যেদিন, মনে রেখো সেদিন, বাঙালীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি চিরতরে হবে বিলিন । আমরাতো ভুলিনি, নীল চাষীদের ওপর নিদারুন অত্যাচারের কথা, ঔপনিবেশিকদের নির্যাতনের বেদনার দিনগুলোর কথা। যুগে যুগে শোষণ নির্যাতন, ন্যায়ের বদলে চালিয়েছিল অন্যায় দুঃশাসন । ধুলো জমে থাকা ইতিহাসের পাতাগুলো একটু ঝেড়ে ফুঁকে নিয়ে দেখতে পাবে স্বযত্নে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে… বাংলাদেশ নামের এ দেশটির জন্মের ইতিকথা। মুক্তিযুদ্ধের কথা, লাখো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা, হাজারো সম্ভ্রম হারানো নারী বীরাঙ্গনাদের গর্বের কথা। স্বজন হারানো মানুষের বিয়োগ ব্যথা!
রেসকোর্স ময়দানে আমি, একপায়ে দাঁড়িয়ে যেনো প্রতিদিন শুনি, রাজনীতির মহাকবি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সেই বজ্রকন্ঠের অমরবাণী-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম “
যে মহামন্ত্রের অমরবাণীর শক্তির প্রেরণায় মনোবলে বলীয়ান হয়ে বাঙালী বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভে সমর্থ হয়েছিল।
ইউনেস্কো সেই মহামন্ত্র অমরবাণী স্বীকৃতি দিয়েছে, বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে গুরুত্বের সাথে ঠাঁই পেয়েছে, এ মর্মবাণী কোটি বাঙালির অন্তর জুড়ে রয়েছে, বিশ্ব দরবারে চিরন্তন মর্যাদার আসন পেয়েছে ।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করি। জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনও করি। সেই বিজয়ের আনন্দেতে বাংলার আকাশে শান্তির পায়রা উড়ে প্রতিদিন। সেই সাথে বয়ে চলেছি লাখ শহীদের আত্মত্যাগের ঋণ।জেনে রেখো, আমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বুকে বিজয়ের চিহ্ন, আমি ৭১ এর বিজয় কালের সেই অগ্নীঝরা দিনের সাক্ষী, একটি গাছ। আমার জন্মের বাস্তব ইতিহাসকে বিকৃত করোনা, শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে। বরং বহু অজানা বাস্তব তথ্য লিখে লিখে বাংলাদেশ সৃষ্টি ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করো। নতুন প্রজন্মের কাছে আমার ইতিহাস জানিয়ে রেখো, ওরা যেনো যোগ্য নেতৃত্বে পথভ্রষ্ট না হয়ে সঠিক পথে চালিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রেষ্ঠ অবদান আমাদের গর্বের জাতীয় পতাকার সম্মান যেনো অক্ষুণ্ন রাখে। অনাগত প্রজন্ম আমাকে স্বগৌরবে সমৃদ্ধ করে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা-কে যেনো চিরসমুজ্জ্বল রাখে।

আমি কালের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে-আমি বেঁচে থাকবো বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তালগাছ’ কবিতায়-
আমি বেঁচে থাকবো জাতীয় সংগীতের পংক্তিমালায়। আমি বেঁচে থাকবো কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের-‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’কবিতায়, আমি বেঁচে থাকবো কবি জীবনান্দ দাশ-এর কবিতায়-“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়”।

-লেখক: গীতিকবি, আবৃত্তিকার ও নাট্যাভিনেতা, habib2729@gmail.com.