Home মতামত অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী পিছিয়ে কেন?

অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী পিছিয়ে কেন?

39

নারীরা তুলনমূলকভাবে অনলাইন জগতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় বেশি সমস্যার শিকার হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় নারী-পুরুষ সকল ধরনের মানুষের প্রবেশাধিকার ও অবাধ বিচরণ তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য; সরকার, সুশীল সমাজ, এনজিও, আইএনজিও, জাতিসংঘের সংস্থা; সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

বর্তমান সময়ে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বসবাসরত মানুষ; যেখানে আমরা সবাই একেক রাষ্ট্রের নাগরিক হবার পাশাপাশি অনলাইন নাগরিক হিসেবে নিজেদের বৈশ্বিক নাগরিকত্বের পরিচয়ও দিন দিন দৃঢ় করে তুলেছি। আজকের যুগে অনলাইন জগত থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত রাখা প্রায় অসম্ভব। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই আমরা নিজেদের আইডেন্টি অনলাইন জগতে শেয়ার করে থাকি । সহজ ভাষায়, আমরা এখন দুটি জগতে বাস করতে শুরু করেছি: বাস্তব এবং ভার্চুয়াল। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে আমাদের বাস্তব জগতের কার্যক্রম স্বশরীরে হওয়ার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে, ফলে আমরা নিজেদেরকে ক্রমশই ভার্চুয়াল জগতে বেশি সক্রিয় রাখতে শিখছি। আমরা যখন দুটো জগতের বাসিন্দা, তাই এখনই সময় বাস্তব জীবনের চলাচল ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো অনলাইন জগতের পদচারণা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়েও আলোচনা করার।

অনলাইন জগতের মাঝে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের জায়গাগুলো যেমন: ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডইন, হোয়াটসঅ্যাপ, ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ডিজিটাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় আমরা কিভাবে সাবধানতার সাথে চলব, তার আলোচনাও দিন দিন বাড়ছে। করোনাকালীন এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তব জীবনের মতো নারীরা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা বৈষম্যের শিকার হয়। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সম্প্রতি বাংলাদেশের ১৬ লাখ মানুষের উপর একটি দ্রুত জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৯১% নারী উত্তরদাতা বলেছেন, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) অনিরাপদ বোধ করেন এবং প্রায় ৫৩% নারী উত্তরদাতা অনলাইনে হয়রানির সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছেন৷ সমীক্ষা বলছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এমন যুবনারীদের একটি বিরাট অংশ এখনো জানেন না – কোথায় এবং কিভাবে অনলাইন হয়রানির রিপোর্ট করতে হয়। এই সমীক্ষা ছাড়াও অনেক বৈশ্বিক সমীক্ষা ইতিমধ্যে নিশ্চিত করেছে যে ভার্চুয়াল ক্ষেত্রে মেয়েশিশু এবং নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণের হার এখনও পুরুষদের তুলনায় কম। ভার্চুয়াল জগতে লিঙ্গ সমতা প্রয়োজন, কারণ “অনলাইন স্বাধীনতা সকল মানুষের অধিকার, এটি কোন লিঙ্গভিত্তিক নাগরিক সুবিধা নয়”। অফলাইন বিশ্বের বাস্তবতার সাথে তুলনা করলে, ভার্চুয়াল জগতে নারীদের অবস্থান তুলনামূলক আরো দুর্বল। অফলাইন দুনিয়ার নারীদের অবাধ বিচরণের বাধা-বিপত্তি নিয়ে তো আমরা অনেক কিছুই জানি। আজকের লেখায় অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় নারীদের পিছিয়ে থাকার কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো:

গভর্নেন্স এর অভাব
আমরা জানি, ভার্চুয়াল বিশ্বের সব কিছুই এক বিশেষ নজরদারিতে থাকে। এখানে কেউ চাইলেই কিছু লুকোতে পারে না, সকলের পদচারণারই রেকর্ড আছে। ইংরেজিতে একে বলে সাইবার ফুটপ্রিন্ট (Cyber Footprint)। তবে মজার বিষয় হলো, এত নজরদারির ভেতর থাকা সত্ত্বেও এখনো অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যবহারকারী/ভোক্তাদের নেতিবাচক কাজকর্মের ওপর জবাবদিহিতামূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চাইলেই ফেক আইডি চালু করা যায়। অবশ্যই সকলের ছদ্মনাম বা অ্যানোনিমাসভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য/সংবাদ জানার স্বাধীনতা রয়েছে। তবে এই সুযোগকে এক দল মানুষ অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের অকল্যাণে ব্যবহার করতে তৎপর। এই একদল মানুষ মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ছদ্মনাম ব্যবহার করে না, বরং একে ব্যবহার করছে অন্যের (বিশেষত নারীদের) মতামত এবং অবাধ অনলাইন জগতের চালচলনকে অপমান করার জন্য। অনলাইন জগতে এই একদল বিকৃত মানসিকতার মানুষ অ্যানোনিমাস কিংবা মিথ্যা পরিচয়ের আড়ালে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের হেয় করে থাকে। এসব বিকৃত মানসিকতার মানুষরাই ফেক আইডির মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করছে, যেমন: কুরুচিপূর্ণ, অশালীন ফটোশপ করা ছবি ছড়িয়ে দেওয়া, নারীদের ব্ল্যাকমেইল করা, যে কারো পরিচয় চুরি করে তার নামে ফেক আইডি খোলা, ব্যক্তিগত ছবি কিংবা ভিডিও অনুমতি ব্যতীতই সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন সাইটে কুরুচিপূর্ণ পোষ্টের মাধ্যমে শেয়ার দেওয়া ইত্যাদি । কেবল ফেক অ্যাকাউন্ট এর মাধ্যমেই যে এসব কুরুচিপূর্ণ ব্যক্তিরা ভার্চুয়াল জগতে নারীদের পদচারনাকে নানাভাবে হেনস্থার শিকার করে এমনটা নয়। এরা কখনও কখনও নিজেদের আসল আইডি দিয়েও নারীদের “চরিত্র” নিয়ে নানা ধরণের গুজব রটায়, নারীদের পোশাক কিংবা নানা ব্যক্তিগত পছন্দ নিয়ে নানাবিধ মন্তব্য করে থাকে, যা ডিজিটাল ইভটিজিং এর মত। অনলাইন জগতে নারীদের ওপর যৌন নিপীড়ন করা এমন দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত আইনানুগ কার্যকর ব্যবস্থার উদাহারণ বেশি না থাকায় দিন দিন এসব কুরুচিপূর্ণ কাজের দৃষ্টান্ত বেড়েই চলছে। এক্ষেত্রে প্রশাসন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের হর্তাকর্তা উভয়পক্ষেরই সম্মিলিতভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা
বর্তমানে অনলাইন জগতে পিছিয়ে থাকা মানে বৈশ্বিকভাবে পিছিয়ে থাকা। এমনিতেই নারীদের সম্পদের অধিকার নিশ্চিতকরণের পথ পুরুষদের সম্পদ অধিকারী হওয়ার পথের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন। ‘দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৮৬% পুরুষ ও ৬১% নারীরা মুঠোফোন ব্যবহার করেন। অতএব মুঠোফোন মালিকানায় নারী-পুরুষের ব্যবধান দেখা যাচ্ছে ২৯%। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩৩% এবং নারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মাত্র ১৬%। অর্থাৎ দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যবধান ৫২%। অনলাইন জগতেও বাস্তব জগতের মতো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আভাস তথা—নারীদের যৌন বস্তু কিংবা সেকেণ্ড ক্লাস সিটিজেন ইত্যাদি অবয়বে দেখার নিদর্শন দেখা যায়। এমনকি অনলাইন জগতে এই চিন্তাধারার অধিক বিকৃত প্রকাশের উদাহরণও বিরল ঘটনা নয়।

বাস্তব জীবনে যেমন নারীদের পাবলিক স্পেসে যেতে প্রায়শই নানা বাধা-নিষেধের সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি অনলাইন জগতেও নারীদের পদচারণা নিয়ে হাজারো কুসংস্কার বিদ্যমান রয়েছে। প্রায়শই বাস্তব জীবনের বিখ্যাত নারী ব্যক্তিত্বদের অনলাইন দুনিয়ায়, অফলাইন জগতের থেকেও বেশি লিঙ্গভিত্তিক সমালোচনার শিকার হতে দেখা যায়। এর প্রধান কারণ- অনলাইনে নেতিবাচক মন্তব্য দেয়া সহজ, যা বাস্তবে কোনো ক্ষমতাশীল নারীর সামনে অবস্থান করে স্বশরীরে করা প্রায় অসম্ভব। অনুকরণযোগ্য নারীরা যখন অনলাইন জগতে নানা হয়রানির শিকার হন, স্বাভাবিকভাবেই তখন সাধারণ নারীরা ভার্চুয়াল জগতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করতে ভয় পেয়ে থাকে। নারী-পুরুষ উভয়েই চাইলে নিজেদের পরিচয় গোপন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকতে পারেন। তবে এই চাওয়াটা যদি “স্বাধীনতা” না হয়ে ভয়ের বশবর্তী কারণ হয়, তবে তা এক ধরনের শোষণ চক্রের মাঝে পড়ে যায়। সামাজিক মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অনেক নারীই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন: ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ইত্যাদি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ঠিকই, তবে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় নিজেদের কোনো ছবি বা ব্যক্তিগত পরিচয় পাবলিকলি দেয়ার সাহস পায় না।

পুরুষদের সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের মতন ভীত হতে দেখা যায় না। অনলাইন জগতের সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েদের চরিত্রের ওপর ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা বাস্তব জীবন থেকেও তুলনামূলকভাবে সহজ। তাই এখানে নারীরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা হারানো নিয়ে বাস্তব জীবনের থেকেও তুলনামূলক বেশি আতঙ্কে থাকেন। একে ডিজিটাল পুরুষতান্ত্রিকতা বলা যায়। অনলাইন জগত এখন অফলাইন জগতের মতই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলা যায়, ডিজিটাল মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের স্বার্থেই সোশ্যাল মিডিয়ার ডিজিটাল পুরুষতান্ত্রিকতা দূরীকরণ একান্ত প্রয়োজন।

মানসিক স্বাস্থ্য সংকট
মানুষের সার্বিক সুস্থতার জন্য দৈহিক-মানসিক সকল ধরনের সুস্থতাই অতীব প্রয়োজনীয়। আমরা প্রায়ই কেবল দৈহিক সুস্থতাকে প্রাধান্য দিয়ে মানসিক সুস্থতার কথা ভুলে যাই। অনলাইন জগতে নারীদের প্রায়শই নানা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। যৌন হয়রানির মতন কুরুচিপূর্ণ কাজের জন্য যেকোনো মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যই ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। অনেক নারীই স্বীকার করেছেন যে- তারা বাস্তব জগতের তুলনায় ডিজিটাল স্পেসে বেশি যৌন-হয়রানির শিকার হন। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাবে সাইবার অপরাধীদের প্রায়শই বিচারের মুখোমুখি হতে হয় না। বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ ভাষার অধিকাংশ নেতিবাচক গালি তথা কুরুচিপূর্ণ শব্দই “নারীর যৌনতাকেন্দ্রিক”। তাই সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ কার্যকলাপের প্রভাবে নারীদের পুরুষদের তুলনায় বেশি মানসিক আঘাতের সম্মুখীন হতে দেখা যায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে পুরুষ আধিপত্য
পরিসংখ্যান বলছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (artificial intelligence) ও আইটি সেক্টরে নারীর চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। ধারণা করা হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় – প্রকৃতপক্ষে নারীরা কিভাবে নিরাপদবোধ করতে পারে তা বোঝায় নারীকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব থাকতে পারে, যেহেতু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নতকরণ এবং নানাবিধ ডাটা অ্যানালাইসিসের কাজে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে পুরুষদের থেকে কম। গবেষকরা বলছেন, আইটি সেক্টর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিভিন্ন কার্যক্রমে নারী কর্মকর্তাদের প্রাধান্য কিংবা সংখ্যার হার কম থাকা অনলাইন জগতে জেন্ডার অসমতা বৃদ্ধি কিংবা অসমতা টিকিয়ে রাখায় কাজ করতে পারে।

কোনো সামাজিক পরিবর্তনই রাতারাতি ঘটে না। সমাজে যে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে প্রয়োজন সকলের সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাস্তব জীবনে যেমন বিশ্বে এখনো সকল নারী অবাধ বিচরণে সক্ষম নন, তেমনি অনলাইন জগতেও রাতারাতি নারীদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিতকরণ সম্ভব নয়। অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন নারীদের নিজেদের হার না মানা উদ্যম এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘদ্ধভাবে আওয়াজ তোলার সাহস। নিরাপদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিশ্চিতকরণে নারীদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করার মনোভাব রাখতে হবে, থাকতে হবে নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ, সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থার সহযোগী মনোভাব। সামাজিক পরিবর্তন আনতে ধারাবাহিক সম্মিলিত ইতিবাচক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি। তবেই একদিন বাংলাদেশের সকল প্রান্তের নারী অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়াতে নির্ভয়ে ও অবাধে বিচরণ করতে নিরাপদ বোধ করতে পারবেন।

লেখক: রেনেকা আহমেদ অন্তু, সদস্য, বাংলাদেশ ইন্টারনেট ফ্রিডম ইনিশিয়েটিভ ওয়ার্কিং গ্রুপ।