বিশ্বের বৃহত্তম মাতৃতান্ত্রিক মুসলিম সমাজ

যুগবার্তা ডেস্কঃ ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে মিনাংকাবাউ জাতিগোষ্ঠী। এই জাতিগোষ্ঠীকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। কাতো-বাতো রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কিংবদন্তি রাজা মহারাজো ধিরাজো। বারো শতকের মধ্যভাগে তিন স্ত্রী ও তিন শিশুসন্তান রেখে মারা যান। এ সময় রাজ্য ও পরিবারের দায়িত্ব নেয়ার মতো রাজপরিবারে উপযুক্ত পুরুষ সদস্য ছিল না। এ সংকটকালে এগিয়ে আসেন বড় রাণী পুথি ইন্দো জালিতো। রাজ্য পরিচালনাসহ রাজার তিন শিশুপুত্রের দায়িত্বভার নেন তিনি। আর এরই মধ্য দিয়েই মিনাংকাবাউদের মধ্যে মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বীজ রোপিত হয়। বর্তমান ৪০ লাখ মানুষের এই জনগোষ্ঠী ধর্ম পরিবর্তন করলেও সেই ঐতিহ্য থেকে সরে যায়নি।
এ অনন্য ও জটিল সামাজিক কাঠামোয় পৈতৃক সম্পত্তি যেমন: ফসল, বাড়ি সবকিছুর উত্তরাধিকারী হয় মেয়েরা। সন্তানেরা মায়ের পদবি গ্রহণ করে এবং পুরুষেরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থাকে। এই জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসের কেন্দ্রে ‘মা’। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে- মা হচ্ছেন সমাজের খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
মিনাংরা ঐতিহ্যগতভাবে প্রকৃতি পূজারী ছিল। ভারত থেকে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম আসার আগে তারা প্রাকৃতিক বস্তুর পূজা করতো। তাদের সংস্কৃতি এখনো আদাত অর্থাৎ স্থানীয় রীতিনীতি, বিশ্বাস ও সর্বপ্রাণবাদী আইন ও হিন্দু বিশ্বাস থেকে পাওয়া রীতিনীতির উপর ভিত্তি করে টিকে আছে।
মাতৃকেন্দ্রিক সংস্কৃতির হওয়া সত্ত্বেও মিনাংরা পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ইসলামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। যেখানে ইসলামি ঐতিহ্যে ছেলেদের বিয়ের পর স্ত্রীকে নিজের ঘরে নেয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু এখানে উল্টো ঘটনা ঘটে। মিনাং বর বিয়ের পর স্ত্রীর বাবার বাড়িতে যায় এবং সেখানেই একসঙ্গে বাস করে। বরের শিক্ষা ও পেশার ওপর ভিত্তি করে কনের পরিবার যৌতুক নির্ধারণ করে।
এ জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে বিয়ে একটি বড় অনুষ্ঠান। বিয়ের দিন বরকে তার বাড়ি থেকে অনুষ্ঠানের জন্য কনের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ ইসলামি রীতি অনুযায়ী নিকাহ পড়ানো হয়। এ সময় মেয়েরা নেচে ও ছেলেরা ড্রাম বাজিয়ে বরকে অভ্যর্থনা জানায়। বিয়েতে কনের পরিবারের সদস্যরা তাদের ঐতিহ্যবাহী সেরা পোশাক পরে এবং মাথায় বহন করে আনা অর্থ ও খাবার বরকে উপহার দেয়।
বিয়ে মিনাং নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দেয়। বিবাহিত নারীরা পরিবারের কর্তৃত্ব, জমি ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে মধ্যস্থতা ও বিরোধ নিষ্পত্তি, বৈবাহিক আলোচনাসহ বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠান পালনে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
তবে পুরুষদের দায়িত্ব এখানে কমেনি। তাদের একটা স্বাভাবিক আয়ের উৎস নিশ্চিত করতে হয়। সন্তানদের ভরণ-পোষণের খরচ বহন করতে হয়। এজন্য অনেকে কাজের জন্য গ্রামের বাইরে যায়, শুধু উৎসবে বাড়ি ফেরে। কিন্তু বাড়ির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পুরুষেরা কখনই কোনো কথা বলে না, সেখানে সব কর্তৃত্ব নারীর।
কথিত আছে, একবার মাজাপাহিত রাজা সুমাত্রার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলে সুমাত্রার রাজা যুদ্ধের পরিবর্তে মহিষের লড়াইয়ের প্রস্তাব দেন। সে লড়াইয়ে সুমাত্রার মহিষের ধারালো শিংয়ের আঘাতে নিহত হয় মাজাপাতির মহিষ। এরপর থেকে মিনাং শব্দ থেকে আসে মিনাংকাবাউ। মিনাং অর্থ হলো বিজয়ী, আর কাবাউ অর্থ জলহস্তী। এ কারণেই মিনাংকাবাউয়ের বাড়ির ছাদ ও নারীদের ঐতিহ্যগত পাগড়ির মাথা মহিষের শিঙয়ের আকৃতির।
কালো, লাল এবং হলুদ রঙের মিনাংকাবাউ পতাকা তিনটি প্রধান পার্বত্য অঞ্চলের প্রতীক বহন করে। যেমন- বিদ্রোহী প্রকৃতির জন্য লুহাক লিমোপুলা কোতো, সাহসিকতার জন্য লুহাক আগাম এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি ও নিয়মের জন্য লুহকি তানাহ দাতার।
এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজে এখন বাইরের সংস্কৃতি প্রবেশ করছে, কলুষিত হচ্ছে তাদের শত বছরের লালিত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। তবুও এ নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠী সময়ের হুংকারের সামনে বুক চিতিয়ে স্বগর্বে তাদের ঐতিহ্য বহন করে যাচ্ছে।