জেড এম কামরুল আনামঃ তিনি প্রমিজ করেছিলেন; অথবা তার সাথে প্রমিজ করেছিলেন প্রিয়তর মানুষ। এই তিনি মানে আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক গবেষক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সন্তান ফয়সাল আরেফিন দীপন। তিনি নিরব বয়ে চলা একটি নদী ছিলেন; কিন্তু তারও যে শত্রু তৈরি হবে বাংলাদেশের মানচিত্রে; তা তিনি ভুলেও ভাবেন নি। যে কারনে নিজের মত করে স্ত্রীকে বলেছিলেন, প্রমিজ করছি আমি আসব। কিন্তু বরাবরের মত তিনি আর তার কথা রাখতে পারেন নি। কেননা, নতুন প্রজন্মের এই প্রকাশককে করা হয়েছে নির্মমভাবে স্তব্ধ। চাইলেও তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না অভিজিৎ রায়দের মত তরুণ নিবেদিত লেখক-কলামিস্ট আর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সম্ভাবনাময়ীদের বই প্রকাশ করা। সম্ভব হবে না নতুন করে কোন নির্মল-উজ্জল প্রচ্ছদে আচ্ছন্ন নতুন বই প্রকাশের।
মুক্তচিন্তার রাস্তাকে সংকীর্ণ করতে যারা ইসলামী ব্যাংকের মত একটি ধর্ম ব্যবসায়ী ব্যাংকের সহায়তা নিতে পারে; যারা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি চর্চা করতে পারে; তাদের বিরুদ্ধে সরকার যে অবস্থান নিয়েছে অতিতে; তা পরিমানের তুলনায় আমার কাছে এখন মনে হচ্ছে একটু কম-ই ছিলো; যে কারনে ষড়যন্ত্রকারীরা সিরিয়াল করে একের পর এক খুন করতে শঙ্কিত হচ্ছে না। যে কারনে নতুন করে প্রাণ গেলো দীপনের। অথচ যখন নির্মম এই হত্যা কান্ডটি হয়েছে; তার একটু পরের ঘটনা ছিলো এমন, ঘড়ির কাঁটা তখন বলছে, বেলা সাড়ে ১১টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষক কোয়ার্টারের গাড়ি বারান্দা। কাফনের কাপড় পরে শুয়ে থাকা ফয়সাল আরেফীনকে দেখতে বহু মানুষের ভিড় সেখানে। এতো মানুষের ভিড় ঠেলে একটা সময় স্বামীর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারলেন স্ত্রী রাজিয়া রহমান। বললেন, ‘প্রমিজ করছি, আমি আসব, তুমি তো আমাকে ছাড়া থাকতে পার না।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক রাজিয়া রহমান। সুফিয়া কামাল হলের কোয়ার্টার থেকে স্বামীকে বিদায় দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বামী ফিরলেন লাশ হয়ে। মর্গে সকালে ফয়সাল আরেফীনের ময়নাতদন্ত চলছিলো। চিকিৎসকেরা খতিয়ে দেখছিলেন মৃত্যুর কারণ। কটি আঘাত, কোথায়, আঘাতের কতোক্ষণ পর মৃত্যু হলো এই সব। আর রাজিয়া-ফয়সাল দম্পতির বড় ছেলে তখন জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা দিতে পরীক্ষার হলে। মৃতদেহ বাড়িতে পৌঁছানোর মিনিট কুড়ি পরে স্বামীকে দেখতে আসেন স্ত্রী রাজিয়া। স্বামী কথার উত্তর আর কোনো দিন দিতে পারবেন না। তবু অনর্গল বলে চলেন রাজিয়া, ‘তুমি তো খালি রাগ করো। দু দিন পর পর রাগ করো। এই যে সেদিন রাগ করে চলে গেলা। আবার তো আসছ। আমি তো জানি, তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পার না। আমি আসবো। বলছিলা না এবার বই মেলার পর বাবা-মা সবাই মিলে আমরা কক্সবাজার বেড়াতে যাবো। তুমি আমাকে ছেড়ে কীভাবে থাকবা? আমরা সবাই আসবো। প্রমিজ।’ রাজিয়া যখন কথা বলে চলেছেন, তখন ফয়সালের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাসেম ফজলুল হক ছেলের মৃতদেহের সামনে বসে আছেন চেয়ার নিয়ে। ছেলের কার্যালয়ের দরজা ভেঙে মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন তিনি। পুলিশ, সাংবাদিকের হাজারো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। রাত একটা পর্যন্ত ছেলের মরদেহ নিয়ে ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজমর্গে। সকালে মর্গ থেকে ময়নাতদন্তের পর ছেলেকে সাথে করে বাড়ি ফিরেছেন। একটা সময় ফয়সালের বৃদ্ধা মাও নেমে আসেন। তিনিও এসে বসেন প্রিয় সন্তানের পাশে। কতো অভিমান সবার মধ্যে! সব অভিমান যেন ফয়সাল আরেফীনের কাছে। স্বজনদের মধ্য থেকে কেউ একজনকে ধরে নিয়ে আসা হলো। তিনি কিছুতেই দেখবেন না ফয়সালকে। চিৎকার করে শুধু বললেন, ‘না আমি দীপন ভাইকে দেখবো না। আমি কিছুতেই দেখবো না ওকে।’
এদিকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সোজা বাবার জানাজায় অংশ নিতে ছুটে গেল ফয়সল আরেফিন দীপনের বড় ছেলে রিদাদ। উপস্থিত সবার কাছে বাবার জন্য দোয়া চেয়ে বলল, সবাই আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। আমার বাবা জান্নাতবাসী হবেন।’
জঙ্গী-জামাত-সন্ত্রাসীচক্রের রাজনৈতিক কৌশলের কালো অধ্যায়ের কারনে নির্মম মৃত্যুর শিকার জাগৃতি প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে; তার পরিবারের সদস্য ছাড়াও লেখক, প্রকাশক বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ উপস্থিত ছিলেন; সবার চোখেই ছিলো কান্নার ধারা। স্বজন-পরিজনদের পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষের চোখেও যখন নির্মম এই মৃত্যুর জন্য বেদনা গলে গলে পড়ছিলো; তখন হয় তো সবার-ই মনে হচ্ছিলো যে, জনগন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে কেবল সরকারের জন্যই নয়; আমাদের সচেতনতা অভাবে। আমাদেরকে সবার আগে সচেতন হতে হবে বিশ্বাস করি আমি। যাতে করে ব্লগার মানেই নাস্তিক; মুক্তচিন্তা মানেই হত্যা করতে হবে। এই সকল চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে দেশের সকল মানুষ।
আব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যখন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; তখন আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে মানুষ এখন তাবৎ দুনিয়ার সব ঘটনাই মুহূর্তের মধ্যে জেনে যাচ্ছে। ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান কি পাচ্ছেন না মানুষ এখন। আর যোগাযোগ? তাও তো এখন সেকেন্ডের ব্যাপার। পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের মানুষের সাথেই এখন যোগাযোগ করা যায় কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আর এর পেছনে যে যন্ত্রটির ভূমিকা সেই যন্ত্রটির নাম কম্পিউটার। এই কম্পিউটারেই যুক্ত হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির নানা বিষয়। ব্লগ এরই একটি আধুনিক সংযোজন যা যোগাযোগ ও মত প্রকাশের একটি মুক্ত মাধ্যম। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরাই এই মাধ্যমের সাথে যুক্ত বেশি। তারা প্রতি মুহূর্তে নানা তথ্য ও মত দিয়ে নিজেরা যেমন জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছেন তেমনই সমৃদ্ধ করছেন সহ-ব্লগারদেরও। ব্লগ নিয়ে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করলেও সে বিষয়টি আলোচ্য নয়। কারণ প্রতিটি ভাল জিনিষেরই ভুল ব্যবহার আছে এবং সেই ভুল ব্যবহারই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। বিশ্বব্যাপী ব্লগারদের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। আর তারা প্রতি বছর ১৫ অথবা ১৬ অক্টোবর ব্লগ এ্যাকশন ডে পালন করে থাকে যেখানে প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যূকে প্রতিপাদ্য করা হয়। ২০০৭ সালে প্রথম ব্লগ এ্যাকশন ডে’র প্রতিপাদ্য ছিল পরিবেশ। পরবর্তিতে দারিদ্র, জলবায়ূ পরিবর্তন, খাদ্য, পানি, আমাদের শক্তি ইত্যাদি প্রতিপাদ্য হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে ব্লগাররা হোয়াইট হাউজ ও জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচীসহ অনেক আšত্মর্জাতিক সংস্থার সমর্থন কুড়িয়েছে। বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই ব্লগ নিয়ে অনেক তরুণ কাজ করলেও এদের মধ্যে কোন সাংগঠনিক যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ব্লগার্স ক্লাব গড়ে উঠেছে এবং তারা মাঝে মধ্যে কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানও করে থাকে। তবে বড় ধরণের সাংগঠনিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিছু তরুণ ব্লগার। এরা ২০১২ সালের শেষ দিকে কখনও শাহবাগে, কখনও পাবলিক লাইব্রেরী প্রাঙ্গনে, কখনও সাম্পানে বসে কখনও বা চায়ের আড্ডায় সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। এসব আলোচনার বিষয়বস্তু পরে তারা ব্লগের মাধ্যমে সবাইকে অবহিতও করেন। এই ব্লগের লেখকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চিন্তা দেখে মাঝে মাঝে খুবই আশ্চয় হয়েছি আমি। একজন নগণ্য শ্রমিক নেতা, লেখক ও উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আমার সাথে বিভিন্ন স্তরের মানুষের যোগাযোগ আছে। আর তারই ধারাবাহিকতায় আমার পরিচয় হয় অনলাইন প্রেস ইউনিটির বেশ কিছু সদস্যর সাথে; পরিচয় আছে ব্লগার্স ক্লাবের সদস্যদের সাথেও। যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখে এবং তাদের লেখা পড়ে অনেক না জানা কথা জানার সুযোগ হয়েছে আমার নিজেরও। এত ভালোর মধ্যে দু’একটি মন্দ থাকতেই পারে। তাই বলে হত্যা! মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়েই জঙ্গী-জামাত-সন্ত্রাসীচক্র সকল ভালো লোকদের মুখ বন্ধ করতে পারবে! জানি পারবে না। একজন অভিজিৎ নেই তো কি হয়েছে আমার মত অসংখ্য মানুষ সত্য বলতে ও লিখতে তৈরি হচ্ছে। মানুষকে হত্যা করে নয়; বুঝিয়ে-শিখিয়ে-জানিয়েই আনা সম্ভব বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিজয়। আর সেই বিজয়ের রাস্তাকে প্রশস্থ করতে নতুন প্রজন্মের এগিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই। যেমন বিকল্প নেই সত্যের-সাহসের-সুন্দরের…
লেখক: চেয়ারম্যান, সোনাগাজী উপজেলা পরিষদ