সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে পুলিশ প্রশাসনও সুনির্দিষ্ট করে তাত্ক্ষণিক কোনো তথ্য জানাতে পারছে না। তারা শনাক্ত করতে পারছে না কে কাকে কী কারণে খুন করে লাশ নির্জন স্থানে ফেলে রাখছে। এ পরিস্থিতিতে অনেকেই ভুগছেন আতঙ্কে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, চলতি অক্টোবর মাসে ২৫ দিনে (গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) সারাদেশে খুন হয়েছে ২০৬ জন। আর গত সেপ্টেম্বর মাসে খুন হয়েছিল ৩১৩ জন। এর আগের মাসে (আগস্ট) খুনের ঘটনা ঘটেছে ২৮০টি। এছাড়া দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানের ১৬০ দিনে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ২৪৫ জন। এরমধ্যে ৫০ জন মাদক ব্যবসায়ী দু’পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত হন বলে দাবি করেছে র্যাব ও পুলিশ।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশে খুনসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রয়েছে। আতঙ্কিত হবার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। কেউ কেউ দাবি করছে বর্তমানে খুনের সংখ্যা বেড়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ তথ্য সঠিক নয়। বরং অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় খুনসহ অন্যান্য অপরাধের সংখ্যা কমেছে। যা বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানেই প্রমাণিত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, যেসব ঘটনা ঘটছে তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে প্রত্যেকটি ঘটনা পুলিশ কঠোর ভাবে মনিটরিং করছে।
জানা গেছে, গত ২১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার পাঁচরুখী এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দুই পাশ থেকে পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চারজনের লাশ উদ্ধার করে। তাদের মাথায় গুলির ক্ষত ছিল। পাশাপাশি ভারী কিছু দিয়ে তাদের মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়। লাশগুলোর পাশেই পাওয়া গেছে দুটি দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র ও একটি মাইক্রোবাস। নিহতরা হলেন— মাইক্রোবাস চালক লুত্ফুর রহমান মোল্লা, বাসচালক ফারুক হোসেন, বেকার শ্রমিক সবুজ সরদার ও জহিরুল ইসলাম। শেষের তিন জনের বাড়ি পাবনা আতাইকুল ইউনিয়নে। নিহতদের স্বজনদের দাবি জিন্স প্যান্ট ও শার্ট পরা কিছু অস্ত্রধারী গত ২০ অক্টোবর বিকালে ফারুকসহ চারজনকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের রাখা হয় ভুলতা ফাঁড়িতে। পরের দিনই ৪ জনের লাশ পাওয়া যায়। তবে ভুলতা ফাঁড়ি ও জেলা পুলিশ এ অভিযোগ অস্বীকার করছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল আল মামুন বলেন, বিষয়টি (গুলিবিদ্ধ ৪ লাশ উদ্ধার) আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। এ ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লাশ উদ্ধারের ঘটনায় যে বিষয়গুলো আসছে সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। যদি কারো (পুলিশ) গাফিলতি থেকে থাকে, তার বিরুদ্ধে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব। পুলিশের এ কর্মকর্তা আরো বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, অনেকে আমাদের (পুলিশ) বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে। চার লাশ উদ্ধারের ঘটনায় এমন কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্রুত বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে আশা করছি।
একের পর এক খুন:মাসের শুরুতেই ১ অক্টোবর বান্দরবানের নাইক্ষ্যাছড়ি ইউনিয়নের অরণ্য থেকে পুলিশ তিন জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে। এরা হলেন – আনোয়ার হোসেন ওরফে আনাইয়া, পারভেজ ও হামিদ হোসেন। পুলিশ বলেছে, পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই ডাকাত দলের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তারা নিহত হতে পারেন। একই দিন রাজধানীর ভাটারা এলাকার একটি দেয়াল ঘেরা খালি জায়গা থেকে পুলিশ রাজিব হোসেন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে। ওইদিনই বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে নিহত হন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আনসার আলী দিহিদার ও কর্মী শুকুর আলী শেখ।
২ অক্টোবর রাজধানীর কামরাঙ্গীচর এলাকায় দিনদুপুরে ছুরিকাঘাতে নিহত হন আরিফ হোসেন নামে এক যুবক। টঙ্গী এলাকায় পিটুনিতে নিহত হন যুবক শহিদুল ইসলাম শাহিন। ৪ অক্টোবর ঢাকার ধামরাই এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হন হাসেম আলী নামে এক ব্যক্তি। নরসিংদী জেলা সদরের চরাঞ্চল করিমপুরে গ্রামবাসীর টেঁটাযুদ্ধে নিহত হন আনোয়ার আলী ও আবদুল মোতালিব। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বিবদমান দুই গ্রুপই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উত্তর সোনাপাহাড় এলাকায় জঙ্গি আস্তানায় আত্মঘাতী বিস্ফোরণের পর দু’জনের ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করে র্যাব। র্যাব জানিয়েছে, নিহত দু’জন জেএমবির সক্রিয় সদস্য। একই দিন ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কৃষক লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হন নাজিম আলী নামে এক যুবক।
৮ অক্টোবর পুরান ঢাকায় শামীম আলম নামে এক যুবক দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন। একই দিন কুমিল্লায় আদালতে একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার সময় বাস থেকে নামিয়ে রড ও হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সাজ্জাদ হোসেন নামে এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যা করা হয়। ৯ অক্টোবর কুষ্টিয়া সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার নূর মোহাম্মদকে নিজ বাসায় হাত-পা-মুখ বেঁধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৩ অক্টোবর যশোরের পুরাতন কসবা এলাকায় তাইজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিন কক্সবাজারের রামু উপজেলার খাদ্যগুদাম এলাকা থেকে ছাদের রেজ নামে এক বিএনপি নেতার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৫ অক্টোবর রাজধানীর শ্যামপুর আইজি গেট ব্যাংক কলোনি বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আবদুর রাজ্জাক নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হন।
১৬ অক্টোবর নরসিংদী জেলা সদরের ভগীরতপুরের একটি বাড়িতে পুলিশের অভিযানে এক নারীসহ দুই ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতরা জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির সদস্য। ২১ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে ৪ গুলিবিদ্ধ লাশের পাশাপাশি রাজধানীর তুরাগ থানা এলাকার কাশবন থেকে দুই ব্যক্তির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরা হলেন কামাল শেখ ও ইমাম শেখ। পুলিশ জানিয়েছে, দু’জনের বিরুদ্ধেই ফরিদপুরে ডাকাতির মামলা রয়েছে। তবে কী কারণে তারা মারা গেছে পুলিশ গতকাল পর্যন্ত জানাতে পারেনি। এছাড়া গত ২৪ অক্টোবর জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় হালিম মিয়া (৪০) নামে এক কৃষক খুন হন। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার গাজীপুরের শ্রীপুরে ওমর ফারুক নামে এক শ্রমিক লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
-ইত্তেফাক