কিশোর–কিশোরীর স্বাস্থ্যের জন্য বছরে মাথাপিছু ব্যয় ৮৬ পয়সা

যুগবার্তা ডেস্কঃ দেশে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৩০ লাখ। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের জন্য মাথাপিছু সরকারি ব্যয় বছরে মাত্র ৮৬ পয়সা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর-কিশোরীরা এই বয়সে নতুন ও ভিন্নতর স্বাস্থ্যসমস্যার মুখোমুখি হয়। এসব সমস্যা আবেগ, আচরণ এবং যৌন আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। একজন কিশোর বা কিশোরীর শারীরিক, বোধ, আবেগ, সমাজ ও অর্থনীতি-সম্পর্কিত অর্জন পরবর্তী জীবনের ভিত্তি তৈরি করে। তাই এদের স্বাস্থ্যচাহিদা আড়াল করা ঠিক নয়।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, কিশোর-কিশোরীদের নানা বিষয়ে আগ্রহ থাকে। অনেক সময় তারা ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে পারে না। তারা বিভ্রান্তিতে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। এই বয়সে স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে স্বাস্থ্যতথ্য বেশি প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন যৌথভাবে কিশোর-কিশোরীদের বৈশ্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে। সেই বিশ্লেষণ ‘আওয়ার ফিউচার: আ ল্যানসেট কমিশন অন অ্যাডলসেন্ট হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ চলতি বছরের ১১ জুন চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট-এ ছাপা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করলে তিন ধরনের লাভ—এই লাভ কিশোর বয়স, পরিণত বয়সে পাওয়া যায় এবং ভবিষ্যতে শিশুরাও তার লাভ পায়।

কারা কিশোর-কিশোরী: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞায় ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা কিশোর-কিশোরী (অ্যাডলসেন্ট)। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) বলছে, ২০১৬ সালের জুলাই মাসে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ। এদের মধ্যে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৩০ লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী।

সেই হিসাবে কিশোরীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের এদেশীয় পরিচালক ওবায়দুর রব প্রথম আলোকে বলেন, দেশে বিবাহিত কিশোরীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। বিবাহিত, গর্ভবতী ও মা হিসেবে এদের জন্য সরকারের স্বাস্থ্যসেবা আছে। এনজিওগুলো এদের সেবা দেয়। তবে কিশোর ও অবশিষ্ট কিশোরীদের জন্য সেবা নেই বললেই চলে।

সেবা পায় না মূলত প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ কিশোর এবং অবিবাহিত প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ কিশোরী। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই ২ কোটি ৯০ লাখ কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, তেমন কার্যক্রমও নেই।

ল্যানসেট-এর ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, কিশোর বয়সেই স্বাস্থ্য সবচেয়ে ভালো থাকে। অধিকাংশ দেশে দেখা গেছে, এই বয়সে মৃত্যুহার সবচেয়ে কম। কিশোর বয়সের আগে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ও কিশোর বয়সের পরে দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। শিশু বা বয়স্কদের তুলনায় তাদের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা কম। প্রবলভাবে বলবৎ থাকা এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বৈশ্বিক নীতিতে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য কম গুরুত্ব পেয়েছে এবং বিনিয়োগ কম হয়েছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাত্র দুটি কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্য (এমএনসিএইচ) কর্মপরিকল্পনার
অধীনে প্রজনন ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ করে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এই খাতে বছরে তাঁদের খরচ এক কোটি টাকার মতো।

অন্যদিকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের আর্থিক সহায়তায় ১২৭টি মা ও শিশুকল্যাণকেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কিশোর-কিশোরীবান্ধব সেবা দিচ্ছে তারা। এতে বছরে তাদের বরাদ্দ দেড় কোটি টাকার মতো।

এই দুই অধিদপ্তর বছরে আড়াই কোটি টাকা খরচ করছে ২ কোটি ৯০ লাখ কিশোর-কিশোরীর স্বাস্থ্যের উন্নতিতে। অর্থাৎ বছরে মাথাপিছু খরচ ৮৬ পয়সা।

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ছাড়া কয়েকটি এনজিও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ করছে। সূর্যের হাসি ক্লিনিক, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডসহ কিছু এনজিও বিচ্ছিন্নভাবে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম।

ওবায়দুর রব বলেন, স্বাস্থ্যসেবার চেয়ে কিশোর-কিশোরীদের বেশি দরকার সঠিক তথ্য। স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে স্বাস্থ্য বিষয়ে পাঠ্য আছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেগুলো অনেকটা ঐচ্ছিক বিষয়ের মতো পড়ানো হয়। কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো অবশ্যপাঠ্য করা উচিত।

ল্যানসেট-এর প্রবন্ধে এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে কামরুন নাহার বলেছেন, সবার আগে এই খাতে বিনিয়োগ বা বাজেট বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে।

আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস: আজ ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। বিশ্বের অনেক দেশে আজ জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হচ্ছে। জনসংখ্যা দিবসের এই বছরের প্রতিপাদ্য: ‘কিশোরী স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করো’।

ঈদের দীর্ঘ ছুটির কারণে প্রস্তুতি না থাকায় আজ বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে না। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, দিবসটি ২১ জুলাই সরকারিভাবে পালন করা হবে।প্রথম আলো