যুগবার্তা ডেস্কঃ স্ত্রী হত্যার পর জিজ্ঞাসাবাদের নাটকীয়তায় পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হবে কি না, তা নিয়ে উভয়সংকটে পড়েছেন পুলিশের নীতিনির্ধারকেরা। কর্মকর্তাদের একটি অংশ মনে করে, বাবুল যদি অপরাধী হন, তাহলে প্রচলিত আইনে তাঁর সাজা হওয়া উচিত। আরেকটি অংশ মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাবুল সন্দেহের ঊর্ধ্বে নন। বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষায় তাঁর সরে যাওয়া উচিত।
বাবুল আক্তারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন এখনো মনে করেন, বাবুল স্ত্রী হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন না। বাবুলের পদত্যাগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার বাসায় আসার পর থেকে বাবুল এ বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বাবুল বাসায় ফেরার পর গত রোববার থেকে তাঁর বাসার সামনে পুলিশের নিরাপত্তাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি), অতিরিক্ত ডিআইজি ও পুলিশ সুপার পদের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত শুক্রবার রাতে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর তিনজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা বাবুলকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে সময়ই তাঁর পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হয়। তবে পদত্যাগপত্রটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে জমা পড়েনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় মাহমুদা হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ তাঁদের হাতে রয়েছে দাবি করে তিন ডিআইজি বাবুলকে দুটি বিকল্প দেন। বাবুলকে বলা হয়, তাঁকে বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে, নইলে তাঁকে মাহমুদা হত্যা মামলায় আসামি হতে হবে। বাবুল বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেন।
বাবুলের ঘনিষ্ঠ একাধিক কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তাদের চাপের মুখে বাবুল বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। এ ছাড়া তাঁর আর কিছু করার ছিল না। কেননা, পুলিশের মতো বাহিনীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
ওই কর্মকর্তাদের একজন বলেন, ‘আমরা স্যারদের বলেছি, কোনো মাঝামাঝি পন্থা থাকতে পারে না। মাহমুদা হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হতে হবে। বাবুল যদি এতে জড়িত হন, তাহলে অন্য আর দশজন অপরাধীর যা হয়, তাঁরও তা হবে। আর তা না হলে তিনি সসম্মানে পুলিশ বাহিনীতে থাকবেন। মামলার তদন্তপ্রক্রিয়াও স্বচ্ছ হওয়া উচিত।’
বাবুলের সমসাময়িক আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন কত কথা শুনছি। বাবুল শিবির করতেন, তিনি সরকারবিরোধী। কিন্তু ভেবে দেখুন, কর্মজীবনে এই সরকারের আমলেই বাবুল একাধিক বিপিএম, পিপিএম (পদক) পেয়েছেন। তাঁর ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রথম সারির হিসেবেই পদোন্নতি পেয়েছেন। এখন বাবুল বিপদে পড়ার পর নানা কথা বলা হচ্ছে। ফাইল চালাচালি চলছে। বাবুলকে যদি শাস্তি পেতে হয়, তাহলে তা স্বচ্ছভাবে হতে হবে। বাবুলের মতো কর্মকর্তা মাথা নিচু করে চুপচাপ বাহিনী থেকে সরে যেতে পারেন না।’
পুলিশের ডিআইজি পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তদন্তপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে সব মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। কর্মকর্তাদের নিজেদের মধ্যেই এ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। তবে সবাই যে বিষয়টি নিয়ে একমত তা হলো, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাবুলকে বাহিনী থেকে সরিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তা নেতিবাচক চর্চার উদাহরণ হয়ে থাকবে। তদন্তপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকলে মানুষও পুলিশের ওপর আস্থা হারাবে। এসব কারণে বাবুলের পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া হলেও বিষয়টির সুরাহা হচ্ছে না। পদত্যাগপত্রটি পুলিশেরই একজন নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তার কাছে আছে। আর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বাবুলের সমসাময়িক কর্মকর্তাদের মনোভাবও বোঝার চেষ্টা করছেন। তদন্তপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাবুলকে ডাকবেন বলে জানান।
মাহমুদা হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, বাবুল মামলার বাদী। তাঁর সঙ্গে মামলা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। এ জন্য তাঁকে ডাকা হতে পারে। কীভাবে ডাকা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘চিঠি ইস্যু করা হবে।’
এদিকে বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি এখনো বিশ্বাস করেন যে বাবুল এ হত্যায় জড়িত নন। হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার সবই অপ্রাসঙ্গিক। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, বাবুল একজন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা। অনেক সূত্রবিহীন মামলাও তিনি খুঁজে বের করে ফেলেছেন। সেই বাবুল যদি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তিনি কি সরাসরি জড়িত হবেন? নিজের সোর্সকে দিয়ে খুনটি করাবেন? তা-ও বাড়ির কাছে, ছেলের সামনে? বিষয়গুলো ভেবে দেখা উচিত।
মোশাররফ বলেন, ‘আমি শুধু আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাই। কিন্তু হত্যার বিষয়টিকে ছাপিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে হইচই চলছে। মূল কথা হচ্ছে, খুনি কে? বাবুল যদি মাহমুদাকে হত্যা করে থাকে, এটা প্রমাণ হলে তার শাস্তি হবে।’ তিনি বলেন, হত্যার তদন্ত বিষয়ে এখনো তিনি বা তাঁর পরিবারের সঙ্গে পুলিশের তদন্তকারীদের কেউ যোগাযোগ করেননি।
৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন।