যুগবার্ত ডেস্কঃ অগ্নিযুগের বিপ্লবী কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরী আর নেই। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ভদ্রদিয়া গ্রামের নিজ বাড়িতে এই মহান বিপ্লবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খুলনায় পার্টি অফিসে এবং শহীদ হাদিস পার্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে তাঁর মরদেহ খুলনা মেডিকেল কলেজে হস্তান্তর করা হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ এক বিবৃতিতে কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ বলেন, কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরী একজন সাচ্চা বিপ্লবী হিসেবে এদেশের বাম-কমিউনিস্ট আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিভৃতচারী মানুষ হিসেবে গ্রামে থেকেই সব সময় পার্টির কর্মকা-ে সক্রিয় থেকেছেন। নির্লোভ এই মানুষটি সবসময় তরুণদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন। প্রগতিশীল আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্যঃ
কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরীর জন্ম ১৯২০ সালের ২০ জুন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানাভুক্ত ভদ্রদিয়া গ্রামে। স্কুলে পড়া অবস্থায়ই তিনি ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৩৬ সালে তিনি অনুশীলন দলে নাম লেখান। তখন তাঁর কাজ ছিল দলের বিভিন্ন চিঠিপত্র গোপনে একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছে দেয়া। পরবর্তীতে অন্য সহযোদ্ধার সঙ্গে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন, এ বছরই তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। একই বছর তার বাবা মারা যান। তিনি খুলনার ডুমুরিয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তাঁর পড়াশুনায় ছেদ পড়ে। দুই বছর বিরতির পর তিনি ১৯৪১ সালে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমিতে (বর্তমান ব্রজলাল কলেজ) আইএ-তে ভর্তি হন। কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তিনি ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হন। ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট তিনি কলেজ থেকে গ্রেফতার হন। এক বছর কারাভোগের পর ১৯৪৩ সালে মুক্তি পান।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পুরোদমে কৃষক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন। এ সময় কৃষকদের মধ্যে খাস জমি বণ্টনের দাবিতে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলেন। জমির লবণাক্ততা দূর করার জন্য তিনি কিংবদন্তি কৃষক নেতা কমরেড বিষ্ণু চ্যাটার্জীর সাথে জমিতে বাঁধ নির্মাণে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।
১৮৪৫ সালের শেষের দিকে তিনি চুকনগর দিবাকলী বিদ্যা ভবনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তখন তিনি তেভাগা আন্দোলনে যুক্ত হন। তেভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৪৬ কমরেড বিষ্ণু চ্যাটার্জী ও কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরীকে আসামী করে মামলা করা হয়। ক্ষেতমজুর সম্মেলনে যোগদান করতে কলকাতা যাওয়ার পথে কমরেড আব্দুল হক, কমরেড হেমন্ত সরকার, কমরেড প্রবাস চৌধুরীর সঙ্গে তিনি বেনাপোল বর্ডারে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে তিনি রাজশাহী জেল থেকে মুক্তি পান। কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরী জেলে বসে কমিউনিস্ট সাহিত্য পড়তেন। তিনি ঢাকা জেলে অনশনে অংশগ্রহণ করেন। এ অনশনে কমরেড শিবেন শিকদার মারা যান। অনশনে ৩০০ জনেরও বেশী বন্দী অংশগ্রহণ করেছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি পুনরায় পার্টির কাজে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত হন। ওই সময়ে পাকিস্তান বিরোধী সকল আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি খুলনায় সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুষ্টিয়ায় থেকে এবং পরবর্তীতে কলকাতা থেকে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি খুলনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীন দেশে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির সঙ্গে যুক্ত থেকে সমাজপ্রগতির লড়াইয়ে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। কমরেড কামাখ্যা রায় চৌধুরী ছিলেন কমরেড বিষ্ণু চ্যাটার্জী, কমরেড রতন সেন, কমরেড জসিমউদ্দিন ম-লের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা।
বার্ধক্যও তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে দূরে রাখতে পারেননি। গত ১৯, ২০, ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী দক্ষিণ এশিয় কনভেনশনে উদ্বোধন হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। মৃত্যুর আগে তাঁর দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজে দান করে যান।