Home মতামত ৭১ -এর ছোট্ট শিশুর এক টুকরো স্মৃতি!

৭১ -এর ছোট্ট শিশুর এক টুকরো স্মৃতি!

44

মো: হাবিবুল্লাহ : গভীর রাত, নিঝুম আকাশে সেদিন চাঁদ উঠেনি, চারদিক অমবশ্যার থমথমে আধাঁরে ঢেকে ছিল পৃথিবীটা, তখন ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন ছিল পুরো জীবজগৎ ও প্রকৃতি। ঘরের পিছনে আম কাঁটাল গাছের পাতাগুলোতে কুয়াশা জমছিল, শিশির ফোঁটাগুলো মাটিতে পরে ঝরা পাতার উপর পরে টপ টপ শব্দ হচ্ছিল, হঠাৎ রাতে নীরবতা ভেঙ্গে ঠাশ্ ঠাশ্ বিকট শব্দে আমার পুরোপুরি ঘুম ভেঙ্গে গেল, থর থর করে কাঁপতে থাকি, মনের ভিতরে অজানা ভয়ে আতংকিত ছিলাম।
নিজের মনকে প্রশ্নকরি কিসের শব্দ হলো এটা ? আমি সেদিন ছিলাম ছোট্ট শিশু, কি করে আন্দাজ কববো, কিসের শব্দ ওটা, জীবনে প্রথম এমন কানফাটা আওয়াজ শুনিছি। ততক্ষণে নিস্তব্দ পৃথিবীটা সরব হয়ে উটছে বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু, মানুষের ডাক চিৎকারের কোন আওয়াজ পাইনি, সবাই যেনো ইচ্ছে করেই চুপ হয়ে আছে।
পাখিগুলো প্রকম্পিত শব্দে, ভয়ে অনিচ্ছাকৃত কিচির মিচির আওয়াজে-পরিবেশটাকে ভারী করে তুলেছিল।
দুর থেকে নবজাতকের কান্না ভেসে আসছিল, শিশুরা নাকি বিপদের গন্ধ টের পেয়ে যায় !
মাচার নীচে কুঁচে বসা মুরগীটাও কক কক করে উঠেছিল, পরক্ষণে চুপ হয়, তার ডিমের চিন্তায়, মোরগগুলোও অজানা আশংকায় একসাথে চিৎকার করছিল। মোরগের ভোর বেলার ডাক শুনে বুঝা যায় এখন ভোর হওয়ার পথে, সেদিন গভীর রাতের অস্বাভাবিক চিৎকারে পরিবেশটা আরো ভৌতিক মনে হচ্ছিল। ওদের স্বভাবত ডাক, প্রতিদিনকার ভোরবেলার ডাক এক নয় তাই কেমন ভিন্ন রকম বিপদের গন্ধ মনে হচ্ছিল ।

ঘরের দাওয়ায় শুয়ে থাকা ধইলা কুকুর বুধি উচ্চস্বরে ঘেউ ঘেউ শুরু করে ছিল, প্রাণ পণ এপাশ ওপাশ ছুটাছুটি করে মাঝে মাঝে ঘরের দরজায় মাথা ঠুকছিল, ককুরও নাকি শত্রুর উপস্থিতি ভালভাবে বুঝতে পারে ! বোবা প্রাণী. কথা বলতে না পারুক, তার প্রভুকে জেগে তোলার চেষ্টায় হয়ত এমনটি করছিল, ধানের গোলার উপর আরাম করে শুয়ে ছিল সাদা বিড়াল প্রিয় মিমিটা । বুধির অদ্ভুত ঘেউ ঘেউ শুনে একবার আধখোলা চোখে মিউ মিউ করে চুপ হয় মিমি । হঠাৎ তার চোখদু’টি বিস্পারিত করে, আধাঁরে তার চোখগুরৈা চিতার চোখের মত জ্বল জ্বল করছিল, খানিকবাদে লাফ দিয়ে পড়ে আমার গায়ে, এ্যাঁ বলে ভয় পেয়ে।আমি চিৎকার দিয়ে উঠি । শীতের রাত ভাগ্যিস গায়ে লেপ ছিল, তাই কোন ব্যথা পাইনি।

পাশে ঘুমিয়ে থাকা আব্বা ও আম্মা দুজনেই হুরমুর করে ওঠে বসেন, অন্ধকারে তাঁদের মুখ চোখ দেখতে পারছিলাম না, মা যেনো হারিকেনটা খুঁজছিলেন ! হাতে পেয়ে আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
মা ফিস ফিস করে বাবাকে কি যেন বলছেন,আমরা শিশু বলে মা কিছু লুকাচ্ছিলেন,
কিছু না বুঝে মাকে জাপটে ধরে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলছিলাম, কিসের শব্দ হচ্ছে আম্মা?
মা তখন পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, বাবা ও কিছুনা ঘুমিয়ে পড়ো বাবা,
ঐ পাশের বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে, মনে হয় ওরা বাজি ফোটাচ্ছে !!
মায়ের কথা কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, ভিতরটা যেনো ভয়ে কাঁপছে
মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই আবার সেই টে টে টে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছিল !!
তখন সবার গায়ের রক্ত হীম হীম হয়ে আসছিল।

মুখ দিয়ে কারো কোন কথা বের হচ্ছিলনা সবাই নিশ্চুপ হয়ে গিয়ে ছিল,
আব্বা আল্লাহকে ডাকছিলেন,তিনি চৌকি থেকে নেমে মাকে তাগিদ দিয়ে বলতেছিলেন, সবাইকে নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়, ওদের জেগে ওঠাও। আমি জাগ্রত বলে চৌকি থেকে নেমে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, কিন্তু আমার ভাইবোনেরা লেপে মাথামুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমের মধ্যে ছিল, বড় আপা হঠাৎ টের পেয়ে ওঠে বসে, অস্পুট শব্দে বলে উঠে গুলির শব্দ !
মা তারাহুরা করে হারিকেনের আলোটা আরো বাড়িয়ে নেন,
মাটিতে ধানের খালি বস্তা পেতে ওটার উপর শীতল পাটি বিছিয়ে আমাদের শুয়ে দেন।

ছোট মানুষ, কোন বিষয়ই বেশী সময় মাথায় থাকেনা, কখন যে ঘুমের রাজ্যে পৌঁছে যাই,
রাতে মটিতে শুয়ে ছিলাম কখন যে মা আমাদের চৌকিতে শুয়ে দিয়েছে তা টের পাই নাই,
ঘুম ভেঙ্গে চোখ মেলে দেখি আমরা ভাইবোন সবাই চৌকির উপর লেপ জড়িয়ে শুয়ে আছি
ততক্ষনে রবির আলোয়ে আলোকিত হয়ে গেছে গোটা পৃথিবী, রাতের সবকিছু যেন ভুলে গেছি।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঝলমলে সুর্য্যরশ্মি ঘরের ভিতর এসে পড়ছিল,
সকাল হলেও অন্য দিনের মত সরব ছিলনা, কেমন যেনো থমথমে মনে হচ্ছিল,
ঠাঁকুর বাড়ীর মগ্গুল গাড়িয়ালের গাড়ীর ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ নেই, গরুর গলায় বাঁধা ঘন্টা বাজার শব্দ নেই,
ভোরে ধান দিয়ে ডেকে ডেকে ফেরী করে মুড়ি বিক্রেতার হাঁক ডাক নেই!
সকালে ভাইবোন সবাই একসাথে রোদে বসে গুড় দিয়ে মুড়ি খাচ্ছিলাম,
এমন সময় বাবা বাড়িতে ঢুকেছিলেন, তাঁর চোখে মুখে ছিল উৎকণ্ঠার ছাপ, বিপদের গন্ধ পাচ্ছিলাম।

মনে হলো বাবা রাতের গুলাগুলি ঘটনার সব খবর শুনে এসেছিলেন,
স্পষ্ট মনে পড়ে, বাবাকে দেখে আমি তার মুখপানে শুধু তাকিয়ে্ই ছিলাম,
রাতের বিষয়টা সকালে ভুলে যাওয়ার মত, তাই আপন মনে খেলা করছিলাম,
কিছু কথা স্পষ্ট মনে আছে ,আব্বা বড় বোনকে ডেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছিলেন-
জানিস্ মা, আমাদের উপর ভয়ানক বিপদ ধেয়ে আসেছে, পাক মিলিটারিরা বিরিশিরিতে ক্যাম্প গড়েছে, আজই হয়ত ওরা দুর্গাপুর বাজারে চলে আসবে ! রাতে গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের চাল দেই, পাক সেনারা সেটা জেনে গেছে, আমাকে ওরা মেরে ফেলবে, স্থানীয় দুসররা এই খবর পাক সেনাদের কানে পৌঁছে দিয়েছে, ওদের মানুষ খতম তালিকায় আমার নাম উঠে গেছে! আর যেনো চাল না দেই, তাহলে ডেড লিস্ট থেকে নাম কেটে দিবে। কিছুক্ষণ আগে চাস্টলে ওরা রক্তচক্ষু করে আব্বাকে শাসিয়ে গেছে।

তৈরী হও, আর দেরী করা যাবেনা প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র গুছিয়ে নাও, আজই বাড়ীঘর ছেড়ে সবাইকে গ্রামের দিকে চলে যেতে হবে। স্পষ্ট মনে আছে আমরা ভাইবোন গরুর গাড়ীতে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে দিতে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাঁচা মুলা খাচ্ছিলাম। গরুরগাড়ী দুলতে দুলতে গ্রামের দিকে যাত্রা করছিল….।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর, নিজ গৃহে আমরা ফিরে এসে দেখি, ঘরবাড়িগুলো পরিণত হয়েছিল যেন শ্বশানে,
সেই আমি ছোট শিশুর অস্পষ্ট খন্ড স্মৃতি, আজ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রাণে মনে । সেদিনের পাক সেনারা নিরীহ মানুষকে হত্যার পৈচাশিক আনন্দ, চরম নিষ্ঠুরতা, বর্বতার ঘৃণ্য ইতিহাস চোখে ভেসে ওঠে, মনের অজান্তে এখনো আতঁকে যাই !

অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা দিয়েছে বাঙালিকে শান্তির ঠাঁই। যাঁর আকুল ডাকে যোগ্য নেতৃত্বে পেয়েছি এ স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় হয়েছে-বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের মহান নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধূ শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর অবদান চির অম্নান, চির ভাস্বর।

বড় হয়ে দারুন কৌতুহল জাগে আমার ছোট্টবেলার স্মৃতিটাকে-
আবার সরেজমিনে স্বচক্ষে স্মৃতির সাথে সত্যতা যাচাই করবো বলে স্থির করি।
তাই যুদ্ধের সময় দেখা গ্রামের বড় বড় তাল গাছ,বৃষ্টি গাছ,পুকুরঘাট, খাল-বিল, বড় বোনের সাথে গিয়ে কংশ নদীতে পা ধোয়ার ঘাট, সব যেনো ছবির মত ঠিক ঠিক আছে দেখে অবাক হয়ে পড়ি।
তাহলে আমার স্মৃতিটা ‍ভুল বা কল্পনা ছিল না। যা দেখেছিলাম সবই ছিল বাস্তব !

যখন দেখি মুক্ত নীলাকাশে আপন মনে উড়তে থাকে আমাদের জাতীয় পতাকা, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক ভেবে, গরবে বুকটা ভরে উঠে , ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর ডাকে সারা দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তাঁদের মহান আত্মত্যাগে,তাঁদের আত্মদানে আমরা অর্জন করেছি এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বীর শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমাদের নিরন্তর বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসা । আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়ের দিন চির অমর হোক।

-লেখক : দেশের খ‍্যাতিমান গীতিকবি, আবৃত্তিকার ও নাট‍্যাভিনেতা।