Home রাজনীতি শ্রমিক লীগের ৭ লাখ সদস্যের মধ্যে ৫ লাখই চাঁদাবাজিতে জড়িত

শ্রমিক লীগের ৭ লাখ সদস্যের মধ্যে ৫ লাখই চাঁদাবাজিতে জড়িত

66

ডেস্ক রিপোর্ট: আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের নামে ৪২৬ খাতে বছরে ২ হাজার ১৬০ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করা হয়। চাঁদা উঠাতে এলাকা, প্রতিষ্ঠান ও খাতভিত্তিক সংশ্লিষ্ট নেতাদের দায়িত্ব দেওয়া আছে। চাঁদা আদায়ের উল্লেখযোগ্য খাত গণপরিবহন। এ খাত থেকে প্রতিদিন তোলা হয় ৪ কোটি টাকার চাঁদা। এছাড়া উল্লেখযোগ্য খাত হলো, ব্যাংকিং, সিটি করপোরেশন, রাজউক, ওয়াসা, ট্যানারি, ডিপিডিসি, ডেসকো, জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা ঘাট প্রভৃতি। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠানেই আছে শ্রমিক লীগের শাখা। দেশব্যাপী ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৫ লাখই চাঁদাবাজির সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অতীতের সব সরকারি দলের শ্রমিক সংগঠনগুলো একই কায়দায় চাঁদা নিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে শ্রমিক দলের নামে বছরে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় করা হতো। চাঁদা আদায়ের খাতও ছিল একই। কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূল শ্রমিক লীগের অনেক নেতাও চাঁদাবাজির টাকায় হয়েছেন শত শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকার অভিজাত এলাকায় রয়েছে অনেকের আলিশান বাড়ি। চলাচল করেন দামি গাড়িতে। জাতীয় শ্রমিক লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে চাঁদাবাজির ভাগাভাগি ও কমিটি গঠন বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব এখন চরমে। এক্ষেত্রে কর্তৃত্ব দ্বন্দ্বে জাতীয় শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান এবং সাধারণ সম্পাদক কে এম আযম খসরু এরই মধ্যে একে অন্যকে বহিষ্কার করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমিক লীগের শীর্ষ দুই নেতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য নেতারাও। এক গ্রুপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে, দাওয়াত পান না অন্যরা। আওয়ামী লীগের সব সহযোগী সংগঠন মাঠে থাকলেও করোনার সময়েও দেখা যায়নি শ্রমিক লীগকে। মঙ্গলবার জাতীয় শ্রমিক লীগ সাধারণ সম্পাদক কে এম আযম খসরু শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির চার জনকে বহিষ্কার করেন। সভাপতিকে সাধারণ সম্পাদক বহিষ্কার করতে পারেন কি না জানতে চাইলে আজম খসরু বলেন, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান আমাকে দুই দিন আগে সংগঠন থেকে অপসারণ করে যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদককে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি সম্মেলনে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। প্রথমে তিনি আমাকে অপসারণ করতে পারেন কি না তাকে প্রশ্ন করুন। তিনি শ্রমিক লীগের কোনো কার্যক্রমে থাকেন না। তিনি ভাই লীগ করেন। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থি কার্যকলাপের অপরাধে তাকেসহ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক (১) খান সিরাজুল ইসলাম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক (৩) বি এম জাফর ও দপ্তর সম্পাদক ফজলুল হককে জাতীয় শ্রমিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় শ্রমিক লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নান বলেন, গত ২২ জানুয়ারি শ্রমিক লীগের সভায় অনেকে মতামত দিলেও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণপরিবহনে শ্রমিক লীগের চাঁদাবাজি অপ্রতিরোধ্য। শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল/ক্রাফট ফেডারেশনের অন্যতম হলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ। এ সংগঠনের একশ্রেণির নেতার একমাত্র কাজ চাঁদাবাজি করা। পরিবহন সেক্টরে মালিক-শ্রমিক দুই পক্ষ থেকে পৃথকভাবে চাঁদা তোলা হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষেও শ্রমিক লীগ নেতারা চাঁদা আদায় করেন। জানা গেছে, পরিবহন সেক্টরে চাঁদা পরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও এর অধীন ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতিসহ বিভিন্ন মালিক সমিতির মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হয়। এর মধ্যে ফেডারেশনের হয়ে সারা দেশে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে প্রতিদিন চাঁদা তুলছে তালিকাভুক্ত ১৮৬টি শ্রমিক ইউনিয়ন। পাশাপাশি অন্য সমিতির প্রতিনিধিরাও আদায় করছেন এ চাঁদা। বিভিন্ন পরিবহন সংগঠন এ চাঁদা আদায় করলেও মূলত শ্রমিক ফেডারেশন এবং শ্রমিক লীগ অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেই দেশের গোটা পরিবহন খাত জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ অনেক যানবাহন মালিক ও শ্রমিকের। যখন তখন ইচ্ছেমাফিক বাস-ট্রাকসহ নির্ধারিত যানবাহনে চাঁদার টাকা ধার্য করে দিচ্ছে। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের মধ্যেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। তবে গডফাদাররা বেশ সতর্কতার সঙ্গেই চলছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকার সড়কের গডফাদারদের নামও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।

জানা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের বাসচালকদের প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা গুনতে হয়। বিশেষ করে ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, গাবতলী, আব্দুল্লাহপুরসহ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদা আদায় করে। একেক রুট থেকে ছয় থেকে সাত ধাপে চাঁদার টাকা তোলা হয়। ঢাকা জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের একজন নেতা, যিনি অতীতে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তিনি এখন দাপটের সঙ্গে চাঁদাবাজি করছেন। শ্রমিক লীগের রাজধানীর থানা পর্যায়ের নেতাদেরও চাঁদা তোলার খাত রয়েছে অনেক। রাজধানীর সবচেয়ে বৃহত্তম পাইকারি আড়ত কাওরান বাজার এখন চাঁদাবাজদের অভয়ারণ্য। নানা উপায়ে দিনভর চলে হরদম চাঁদাবাজি। এদিকে সিবিএ নেতাদের নামে রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাংকিং সেক্টরে শ্রমিক লীগ নেতাদের অপকর্মের যেন শেষ নেই। সবগুলো ব্যাংকই এখন শ্রমিক লীগ সমর্থিত সিবিএ কমিটি দিয়ে চলছে। ব্যাংকিং সেক্টরের দুর্নীতি ও অনিয়মে তারা জড়িত।

পরিবহন সেক্টর ছাড়াও শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত বাকি ১৫টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল/ক্রাফট ফেডারেশনগুলো হলো : জাতীয় রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগ, জাতীয় ঘাট শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ ট্রাক চালক শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সংস্থা শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস, ও খনিজ সংস্থা শ্রমিক কর্মচারী লীগ ফেডারেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন, বশিউক রাবার বিভাগ, সিলেট জোন শ্রমিক/কর্মচারী ফেডারেশন, বাংলাদেশ কুলি শ্রমিক লীগ, মুক্ত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগ, বাংলাদেশ নৌকা মাঝি শ্রমিক লীগ ও বাংলাদেশ বিড়ি শ্রমিক লীগ। এসব সংগঠনের এক শ্রেণির নেতারা নিয়মিত চাঁদাবাজির টাকা তুলে কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের এক শ্রেণির নেতার কাছে দেন। জানা গেছে, জাতীয় শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন আছে ৭৮টি। এসব সংগঠনগুলোর এক শ্রেণির নেতারা চাঁদাবাজি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, টেন্ডার বাণিজ্যসহ নান অপকর্মে নিয়োজিত।

ন্যাশনাল ইউনিয়নগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো :বাংলাদেশ ব্যাংক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক কর্মচারী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্রমিক কর্মচারী লীগ, বাংলাদেশ রেলওয়ে শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্মচারী ইউনিয়ন, ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, বাংলাদেশ সড়ক ও জনপথ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, বিআরটিসি শ্রমিক কর্মচারী জোট, বিমান শ্রমিক লীগ, তিতাস গ্যাস এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন, সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন, রূপালী ব্যাংক কর্মচারী সংসদ, জীবন বীমা কর্মচারী ইউনিয়ন প্রমুখ| অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন আছে।

শ্রমিক লীগের অন্তর্ভুক্ত বেসিক ইউনিয়ন আছে ৩৩৩টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ওয়াসা, রাজউক, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসি, এফডিসি, ডেসকো, গণপূর্ত যান্ত্রিক কারখানা, ট্যানারি, জাতীয় জাদুঘর, কম্পিউটার কাউন্সিল, এনটিআরসিএ, ঢাকা ঘাট, হোটেল সোনারগাঁও, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, কাওরান বাজার রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ প্রমুখ। এসব সংগঠনের এক শ্রেণির নেতারা বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িত। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, অনিয়মেও তারা জড়িত। এছাড়া শ্রমিক লীগের ১২টি সিটি কমিটি, একটি মহিলা কমিটি, একটি যুবক কমিটি, ৬৪টি জেলা কমিটি, ৩০টি আঞ্চলিক কমিটি, ১৫টি বিদেশি কমিটি, ৪৯১টি থানা/উপজেলা কমিটি ও ৩২৭টি মিউনিসিপালসহ মোট ১ হাজার ৩৬৯টি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটির সবগুলোতে একশ্রেণির নেতা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চাঁদাবাজিতে জড়িত।

১৯৬৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় শ্রমিক লীগের সম্মেলনে ফজলুল হক মন্টুকে সভাপতি, আযম খসরুকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রায় ১১ মাস পরে ২০২০ সালের অক্টোবরে ঘোষণা করা হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ঐ বছরের ২০ নভেম্বর সভাপতি মন্টু মারা যান। পরে সহসভাপতি নুর কুতুব আলম মান্নানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।-ইত্তেফাক