শিক্ষক নির্যাতন ও হত্যা: গোড়ায় হাত দিতে হবে

।। মুক্তার হোসেন নাহিদ ।।

‘কান ধরেনি শ্যামল কান্তি-কান ধরেছে বাংলাদেশ’-লিখেছিলাম নারাণগঞ্জে শ্যামলকান্তি স্যার লাঞ্চিত হলে। সাভারে উৎপল স্যার হত্যায় বলতে চাই, ‘ছাত্রের হাতে শিক্ষক হত্যা নয়, জাতিকেই গলাটিপে হত্যা করা হচ্ছে।’ সমাজের গোড়ায় যে পচন ধরছে, তা এখনই নিরাময় না করলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা, গায়ে মল ঢালা, হাতে হাতকড়া পরিয়ে   কারাগারে পাঠানো-এসব ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অশনি সঙ্কেত। বাদশার  আলমগীরের ছেলে শিক্ষাগুরুর পায়ে পানি ঢেলেছে। এ যুগের ছেলেরা আরো এক ধাপ এগিয়ে শিক্ষককে কোলে করে পানিতে চুবাচ্ছে। ছাত্র হয়ে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ! কোন পথে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। এসব নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! কর্পোরেট দুনিয়ার এই সমাজের মানুষ ভোগবাদ, ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের  নোংরা প্রতিযোগিতায় হারিয়ে ফেলছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। তার ফলে সমাজের গোড়ায় যে পচন ধরেছে, শিক্ষক লাঞ্চনা, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা তারই ভয়ঙ্কর ফল। কেবল বর্তমান শিক্ষার্থী’ই নয়, প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের দাঁড়াও লাঞ্চিত হচ্ছেন। সামগ্রিক বাস্তবতায় শিক্ষক ও শিক্ষায়তন আজ চরম নিরাপত্তাহীন।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। কারণ মানবিক মানুষ, মানবিক সমাজ ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনের মূল অস্ত্র শিক্ষা। শিক্ষক হলেন তার মহান কারিগর। ‘রাষ্ট্রপতি থেকে স্থানীয় সরকার’-প্রজাতন্ত্রের সকল আমলা, বিভিন্ন পেশাজীবী কিংবা রাজনৈতিক নেতা-সবার শিক্ষার হাতেখড়ি কোনো এক মহান শিক্ষকের হাতে। দেশ ও জাতির আজকের কর্ণধর কিংবা ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি-সবাইকে তৈরি করেন এই মহান কারিগররাই। অথচ সমাজে এই মহান শিক্ষাগুরুদের পরিচয় সামান্য ‘মাস্টার’। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পাঠশালা-মানুষ গড়ার মহান কারিগরা কেবল অবহেলিত’ই নয়, নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার। নির্মম মৃত্যু হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে।   প্রতিবাদ-সমালোচনা হচ্ছে, কিন্তু প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না। বেশিরভাগ শিক্ষক এ ক্ষেত্রে নীরব। শিক্ষক সংগঠনগুলোও জোরালো আওয়াজ করছে না। তাই শিক্ষক হিসেবে আমি লজ্জিত, ভীত এবং শঙ্কিত। অন্যদিকে কেবল প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করলেই হবে না। কেন এমন করুণ পরিণতি তার আসল রহস্যও উদঘাটন করতে হবে। গোড়ায় হাত দেওয়া জরুরি। তার জন্য দরকার চৌকস ডায়াগনসিস, প্রোপার ট্রিটমেন্ট এবং মেডিসিন। সে দায়িত্ব নিতে হবে পরিবার থেকে রাষ্ট্রকে।

শ্যামল কান্তি স্যার লাঞ্চিত হওয়ার পর প্রতিবাদ হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক এবং নওগাঁর আমোদিনী পাল লাঞ্চিত হওয়ার পরেও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। কিন্তু তা থেমে গেছে। নড়াইলের স্বপন কুমার স্যারকে জুতার মালা পরানো এবং উৎপল কুমার স্যার হত্যার প্রতিবাদে আবার সেই ঝর উঠেছে। এ ঝড়ও থেমে যাবে। আবার হত্যা-নির্যাতনের শিকার হবেন মানুষ গড়ার মহান কারিগরা। এরই মধ্যে গোপালগঞ্জের এক শিক্ষক এখন হাসপাতালে মরণযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাহলে কি এর থেকে মুক্তি মিলবে না? মিলবে। তবে তা করতে হলে সবার আগে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে, তেমনি নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারানো সমাজে যে পচন ধরেছে তা নিরাময় করতে হবে।

আজকের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সাথে যে আচরণ করছে তা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। আশির দশকেও শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতেন। ভয়ে কাঁপতেন। তাহলে এমনটা হলো কেন-বাস্তব বিশ্লেষণে আমার উপলবদ্ধি শাসনের সীমাবদ্ধতা, ভোগবাদী দর্শনে নেশায় সন্তানের দিকে নজর না দেওয়া,প্রযুক্তির অবাধ অপব্যবহার, আকাশ সংস্কৃতি, শিক্ষা ধ্বংসে সাম্রাজ্যবাদী অপকৌশল পারিবারিক বন্ধনে ছেদ পড়ায়ি এই ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে; যা ভবিষ্যতে মহাপ্রলয়ে রূপ নিবে! দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষককে ভক্তি-শ্রদ্ধা না করা, শিক্ষকের কথা না মানতে মানতে এতদুর এসে ঠেকেছে। নানা কারণে রোবট পরিণত হওয়া বাবা-মা’র রোবটিং সন্তানেরাও নৈতিকতা ও মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষক বাবার মতো, বাবা তো নয়! এই প্রজন্ম তো নিজের বাবা-মা’কেই খুন করছে! ১০ টাকার জন্য বন্ধুকে লাশ বানাচ্ছে। লজ্জা, ঘৃণা, আত্মসম্মান, স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ- শব্দগুলো ওদের ডিকশনারিতে নেই। ওদের গ্রাস করেছে আত্মঅহঙ্কার। ‘আমি অমুকের ছেলে’,‘আমি অমুকের ভাই’,‘ আমি অমুক গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস’-এই ‘আমি’অহমবোধে ওরা কাউকে পরোয়া করে না। শিক্ষককে তো পাত্তাই দেয় না। ওদের মননে ঢুকেছে ‘শিক্ষক হলো গরিব মাস্টার,ক্ষমতা-অর্থ বলতে কিছু নেই, ছাত্র পড়িয়ে খায়।’ পরিবার, সমাজ ও বড়ভাইদের গল্প থেকে ওরা সেটাই শিখছে। নিজের জীবনাচরণেও তা প্রকাশ করছে। এখন শিক্ষার্থীরা বিদ্যায়তনে পড়তে নয়, টাইম পাস করতে আসে। বন্ধু-বান্ধবীর সাথে আড্ডা দিতে আসে। ফলে শিক্ষক দেখলে তারা ‘ডন্ট কেয়ার’ভাব দেখায়। কিছু বললেই চড়াও হয়।

দ্বিতীয় শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী যখন বলে‘স্যার আমাকে মারা, ধমক দেয়া, টাচ করা, অপমানজনক কথা বলা আইনে নিষেধ”, তখন ভাবতে পারেন শিক্ষা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! ওই বয়সে এমন বাক্য ওরা কোথায় শিখছে? নিশ্চই পরিবার কিংবা পারিপার্শ্বিকতায়। শিক্ষার্থীকে কিছু বললে বা শাসন করলেই এখন অনেক অভিভাবক তেড়ে আসেন, রীতিমতো মারমুখী ভূমিকায়। শিক্ষার্থীর সামনে শিক্ষককে হেনস্তা করা হয়। ফলে শিক্ষার্থীও বুঝে যায়, শিক্ষক আমার কিছুই করতে পারবে না। করলেও বাঁশ খাবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকরা সম্মান ও চাকরি বাঁচাতে কোনো রকমে গাঁ ভাসিয়ে চলছেন। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ‘ভয়’ শব্দটাই উঠে গেছে। আমি বেঁতের পক্ষে না, কিন্তু শিক্ষার্থীকে মানুষ করে তুলতে কোনো রকম শাসন করতে পারবে না-তা যদি হয় তাহলে এর থেকে মুক্তি মিলবে না। শিক্ষককে শিক্ষার্থীরা তো মানবেই না, উল্টো আঘাত করবে।

অন্যদিকে শিক্ষকরা কেবল শিক্ষার্থীদের হাতেই নয়, প্রাক্তন-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় প্রভাবশালী ও পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের হাতেও অপমান ও নিপীড়নের শিক্ষার হচ্ছেন। ইদানিং যুক্ত হয়েছে ধর্ম অবমাননার ‘অজুহাত’। দুর্নীতি-অনিয়ম কিংবা হীনস্বার্থ সফলের চক্রান্ত-সব ঢাকা হচ্ছে ধর্ম অবমাননার বরাত দিয়ে। এছাড়া ধর্মান্ধদের টার্গেট শিক্ষা, টার্গেট শিক্ষক। সেই সুযোগে স্বার্থ হাসিল করছে প্রভাবশালীরা। শ্যামল কান্তি, হৃদয় মণ্ডল, আমোদিনী পাল ও স্বপন কুমার বিশ্বাস সহ বহু শিক্ষকের ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে।

ফলে নানা কারণে আজ শিক্ষকের হাত বাঁধা, মুখে লাগাম টানা। চিন্তায় শেকল পরানো। শ্রেণিকক্ষে গেলে হৃৎপিণ্ডের কম্পন থামাতেই সময় যায়! কি বলতে কি হয়! কখন জানি সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা চড়াও হয় কিংবা গণআক্রমণ!-এমন একটা পরিস্থিতিতে হারিয়ে যাচ্ছে সৃজনশীল চিন্তা।

চুল কাটতে বলা, ইপটিজিং বাধা দেওয়া, ক্লাস ফাঁকির কৈফিয়ত চাওয়া, শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শাসনের সুরে কথা বলায় শিক্ষার্থীর সরাসরি আক্রমণ কিংবা অভিভাবকের কথার বানে শিক্ষকের জান শেষ হয়। সাথে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কড়া শোকজ। জীবন চালাতে শিক্ষকরাও তাই চলছেন গা বাঁচিয়ে। চলছেন বললে ভুল হবে, চলতে বাধ্য হচ্ছেন।

এখন অবধি কোনো শিক্ষক লাঞ্চনা-নির্যাতনের বিচার হয় নি। বিচারের বাণী কাঁদছে নীরবে নিভৃতে, আর হৃদয়ের রক্তক্ষণে বার বার দগ্ধ হচ্ছেন শিক্ষকরা। আজ উৎপল স্যার, কাল যে আমি, পরশু আপনে এমন করুণ পরিণতির শিকার হব না-তার গ্যারান্টি কে দিবে!

কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস অনিবার্য। উন্নয়নের অগ্রযাত্রাও থেমে যাবে। কারণ মেরুদণ্ডহীন জাতি বেশি দূর এগোতে পারবে না। আর শিক্ষা ছাড়া মেরুদণ্ড সম্পন্ন জাতি গড়া অসম্ভব। সুতরাং সুস্থ্, সুন্দর, সুশৃঙ্খল মানবিক জাতি গঠনে মূখ্য ভূমিকা রাখতে হবে।

তার জন্য শিক্ষা ক্যারিকুলাম, পাঠদান পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পদ্ধতি, প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষা, শিক্ষার্থীদের আদর্শ মানুষ, শৃঙ্খলাবোধ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং মানবিক মানুষ গড়া সহ সামগ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। হাতে বেঁত না থাকলেও শিক্ষার্থীদের শাসন পদ্ধতির ব্যবস্থার বিষয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত কাউন্সিলিং পরিষদ দরকার।

প্রযুক্তির আধুনিকায়ন যেমন উপকার করছে, তেমনি শিক্ষার্থীর জীবন ধ্বংসের প্রধান অস্ত্রেও পরিণত হয়েছে। জীবনযুদ্ধে কর্মব্যস্ত ও বাবা-মা খবরই রাখে না, সন্তান সারারাত জেগে কী করছে? মোবাইলে কি দেখছে, কোন বন্ধুদের সাথে গ্রুপ চ্যাটে মেতে আছে। কাদের সাথে মিশছে? ফলে সন্তান চলছে নিজের ইচ্ছেমতো। বড় ভাই, বোখাটে বন্ধু আর উঠতি নেতাদের পাল্লায় পড়ে হারিয়ে ফেলছে শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা। হচ্ছে মানসিক বিকারগ্রস্ত। জড়িয়ে পড়ছে, মরণনেশা ইয়াবা, গাঁজা-মদ কিংবা মিক্সিং ড্রাগে। হচ্ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। ফলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আজ চরম অবক্ষয়।

অন্যদিকে শিক্ষকের সাথে শিক্ষা পরিচালনা কমিটির বিরোধ ক্রমেই ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। সেই বিরোধে শিক্ষক হচ্ছেন লাঞ্চিত। অনেকেই শিক্ষকদের অনুগত দাস মনে করছে! আবার অভিভাবকরা সন্তানের জন্য শিক্ষকদের সাথে রূহ আচরণ করছে, কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে? এছাড়া বার বার ধর্মীয় অবমাননার দায়ে শিক্ষকদের লাঞ্চিত করা হচ্ছে। বুঝতে বাঁকি নাই, শিক্ষার মোড় ঘুরানো ও শিক্ষককের কণ্ঠরোধ করতে পারলেই এ জাতির ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে খেতে পারবে ধর্মান্ধরা। ফলে শিক্ষা ও শিক্ষক টার্গেট হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব। হারাচ্ছে সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষার মাধ্যমে মূল্যবোধের ভিত্তিকে মজবুত করার প্রয়োজনীয়তা। সে জায়গা দখল করছে অন্য কেউ।

এই অবক্ষয় ও কারণগুলো অনুসন্ধান করে সঠিক পথে দেশকে এগিয়ে নিতে গোড়ায় হাত দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। পচন ঠেকাতে হবে সেখানেই। তা না হলে অপরাধ প্রবণতা, অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে। উৎপল কুমার স্যারের মতো করুণ মৃত্যু কিংবা স্বপন স্যারের মতো জুতার মালা সামনে আরো বহু শিক্ষকের ভাগ্যে জুটবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাই সকলকে জাগতে হবে, জাগাতে হবে।

লেখকঃ শিক্ষক ও কলামিস্ট