Home মতামত মেনিফেস্টো থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে লাইসেন্স পেতে হয় আওয়ামী লীগকে!

মেনিফেস্টো থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে লাইসেন্স পেতে হয় আওয়ামী লীগকে!

67

সোহেল সানি:

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএসএম সায়েম বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে একটা বৈঠক করেছিলেন। তাতে যোগ দেন সেনাপ্রধান জিয়াও। বৈঠকে অংশনেয়া বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর ভাষ্যমতে, জেনারেল জিয়া ওই বেঠকে বলেছিলেন,” Who is a better Awami League than me? I have transmitted the directives of Bangabandhu from Chittagong Radio Station.” জিয়ার বক্তব্যে আওয়ামী লীগের ভেতরেও সেদিন মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অচিরেই জিয়ার আসল রূপ ফুটে ওঠে।
১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হয়ে সায়েম ৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদ বাতিল করেন। রাষ্ট্রপতি সায়েম ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই দলবিধি জারি করেন। ২৫ আগস্ট বৈঠকে দিকবিদিকশুন্য নেতারা। বৈঠক আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত হয়। অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও মহিলা সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। দলের অনুমোদনলাভে আবেদন করেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
আইন মন্ত্রণালয় আবেদনপত্রটি দলবিধির ১০ নম্বর ধারা পরিপন্থী বলে নাকচ করে দেয়। ধারাটিতে বলা হয় “ব্যক্তিপূজা” করা যাবে না। অর্থাৎ জীবিত বা মৃত ব্যক্তির বন্দনা নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিতে নতুন করে মেনিফেস্টো ছাপিয়ে আওয়ামী লীগকে আবার আবেদন করতে হয়। দলটি ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর সরকারি অনুমোদন লাভ করে।
রাষ্ট্রপতি সায়েম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে বলেন, “জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। ২২ মার্চ নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের খসড়াও তৈরি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৩ নভেম্বর মওলানা ভাসানী ঠিক বলে বসেন, ‘শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ নির্বাচন চায় না।” এক
সপ্তাহের ব্যবধানে ১৭ নভেম্বর ভাসানী ইন্তেকাল করেন। সেনাপ্রধান জিয়া শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন এবং ভাসানীর স্বপ্নপূরণেরও অঙ্গীকার করে ন্যাপ (ভাসানী) নেতাদের নজর কাড়েন। ভাসানী ন্যাপের শীর্ষ নেতারা জিয়ার সরকারে ভিড়েন। তাদের বুদ্ধিতে ন্যাপের প্রতীক “ধানের শীষ” রাতারাতি বিএনপির হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৩ আগস্ট জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করে তার সামনে এক সোনালী দ্বার উন্মোচন করে দেন। যাহোক রাষ্ট্রপতি মোশতাক ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক দল বাকশাল আদেশ বাতিল করেন। জাতীয় সংসদ বহাল রাখেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠন করেছিলেন। যাহোক মোশতাক ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা দেন। এজন্য বঙ্গভবনে এমপিদের বৈঠক ডাকেন। স্পিকার আবদুল মালেক উকিল সভাপতিত্ব করেন। ৩/৪জন ব্যতীত সব এমপি মোশতাক মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। আওয়ামী লীগ নামেই মোশতাক আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন । অর্থাৎ
মোশতাক আওয়ামী লীগ ও সরকার উভয় নেতৃত্ব হাতে রাখতে চান। এজন্য জেলখানায় হত্যা করেন জাতীয় চার নেতাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের আপনাআপনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা। তাঁর অস্বীকৃতি বা অনুপস্থিতি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগ্রহণের কথা প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর। তিনি অস্বীকৃতি বা অনুপস্থিত থাকলে স্পিকার মালেক উকিল হবেন রাষ্ট্রপতি। এটাই হলো সাংবিধানিক রূপরেখা। কিন্তু হত্যাকারীদের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদটি অবৈধভাবে দখল করেন খন্দকার মোশতাক। স্পীকার আবদুল মালেক উকিল ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। কারণ তিনি মোশতাকের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। মোশতাক সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলীকে স্ব স্ব পদে শপথ গ্রহণের প্রস্তাব করে তিরস্কৃত হন। বঙ্গভবনে ডেকে পাঠানো অপর দুই নেতার মধ্যে এএইচএম কামরুজ্জামান ছিলেন অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগের পুনর্জীবন ঘটলে কামরুজ্জামান সভাপতি পদের দাবিদার। এটা মাথায় রেখে কামরুজ্জামানকে শিল্পমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে বলেছিলেন মোশতাক। কিন্তু বিমুখ হন। অপর জাতীয় নেতা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকেও অপর তিন নেতার সঙ্গে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দীনের সঙ্গে মোশতাকের শত্রুতা মুজিব নগর সরকার থেকেই। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব দিলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোশতাককে বরখাস্ত করেন এবং ২২ ডিসেম্বর নতুন করে সরকার গঠন করে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন। প্রসঙ্গত জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য কারাগারে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হলে তাতে আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন। খুনীদের একজন তাঁকে সরিয়ে দিলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কারাগারে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রথম সাংগঠনিক সম্পাদক এম কোরবান আলী ও বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ।
মোশতাক বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের প্রায় সবাইকে কারারুদ্ধ করেন। অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, যুবলীগ চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদও কারাবন্দী।
নভেম্বরে ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলে সাজেদা চৌধুরী প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যার বিচার দাবি করেন। ফলে সাজেদা চৌধুরী, সালাউদ্দিন ইউসুফ ও মোজাফফর হোসেন পল্টু গ্রেফতার হন। এ খবরে
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ আত্মগোপনে গেলে নয়া আহবায়ক হন ফণিভূষণ মজুমদার। তিনি দায়িত্বপালনে অস্বীকৃতি জানান। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মোল্লা জালাল উদ্দিন যুগ্ম আহবায়ক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৩ এপ্রিল কাউন্সিলে জোহরা তাজউদ্দীন আহবায়ক করা হয়। ‘১৯৭৮ সালের ৩ এপ্রিল ইডেন কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিল সভাপতি ও কারাবন্দী আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কিন্তু তাতে আরও কোন্দল বেড়ে যায়। এসময় যুবলীগ চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমির হোসেন আমু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে স্বদেশে ফেরানোর দাবি জানান। এরপর ছাত্রলীগের সভাপতি ওবায়দুল কাদের অনুরূপ দাবি করেন। আওয়ামী লীগের ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে নির্বাচিত হন।

রাজনৈতিক দলবিধি জারি করা হয় ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই। আর আওয়ামী লীগ সরকারি স্বীকৃতিলাভ করে ১৯৭৬ সালের ৪ নভেম্বর। যখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি এএসএম সায়েম। তবে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন জেনারেল জিয়া। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন ১৯৭৬ সালের ৩০ নভেম্বর আর রাষ্ট্রপতি হন ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল।
জিয়ার বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুবাদেই আওয়ামী লীগের ফের জন্ম হয়েছে। ” বিএনপি প্রায়শঃই এ কথাটি বলে। কারণ “রাজনৈতিক দলবিধি-১৯৭৬। “কিন্তু আওয়ামী লীগ এ প্রশ্নে বরাবরই নীরব!
সায়েমের ‘রাজনৈতিক দলবিধি আইন’ জারির নেপথ্যেও ছিল নির্বাচন। সেনাপ্রধান জিয়াই যে তা হতে দেননি, রাষ্ট্রপতি সায়েমের বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়। সায়েম তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেন,”আমি সরকারের ওপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছিলাম। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল আমার বিশেষ সহকারী বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের কয়েকজন সদস্য বললো, জিয়ার অধীনে তারা কাজ করতে চান…আমি অপরাহ্ন ২ টা ৭ মিনিটে পদত্যাগ করলাম। বড় দুঃখ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারলাম না। শুধু এই সান্ত্বনাটুকু নিয়ে চলে যাচ্ছি যে, বিশাল ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর নামে শুরু হয়ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং যাঁর নামে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাধ্যমে তা শেষ হয়, তাঁর হত্যা ও জেল হত্যায় যে ভয়াবহ বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি বলে আমার ধারণা। “
অপরদিকে আওয়ামী লীগ নামেই মোশতাক আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। মোশতাক ২৪ আগস্ট জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন। কিন্তু জিয়াকে বন্দী করেন জেনারেল খালেদ। মোশতাক খালেদকে সেনাপ্রধান করতে বাধ্য হন। এ অবস্থায় মোশতাক পাল্টা নেতৃত্বের আশঙ্কায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেন। ফলে মোশতাকের পতন। জেনারেল খালেদ মোশাররফের পছন্দেই বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের পাল্টা অভ্যুত্থানে জেনারেল খালেদ নিহত হন। জেনারেল জিয়া স্বপদে বহাল হন। রাষ্ট্রপতি ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে সায়েমের রাজনৈতিক দলবিধি জারিকালে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের ন্যায় নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এমজি তোয়াবও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন।-লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।