Home মতামত মৃত্যু মাত্র কয়েক মিনিটের পথ!

মৃত্যু মাত্র কয়েক মিনিটের পথ!

61

সরদার মোঃ শাহীন:

ফজরের আজান দিতে তখনও অনেক দেরী। রাত করে জেগে থাকার কারণে ভারী ঘুমটা আমার কেবল এসেছে চোখে। এপিঠ থেকে ওপিঠ করতে যাবো, অমনি ঊষার ডাক। ঊষা আমাদের হাসপাতালের সিনিয়র সিস্টার। শোনিমের মায়ের জন্যে ক’দিন ধরে বাসায় ডিউটি করে। রাতভর জেগে থাকে। জেগে থাকে শোনিমের মায়ের শিয়রে। বেচারী শোনিমের মা। সে যেমনি একজনের মা, তেমনি তারও মা আছেন একজন।

ক’দিন ধরে সেই মায়ের জন্যে পরিশ্রম করতে করতে আর টেনশান নিতে নিতে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছে। রাখা হয়েছে বিশেষ কেয়ারে। না রেখে কোন উপায়ও নেই। তার খুব ঘুম দরকার। দরকার টানা ঘুম। আর খাওয়া দাওয়া দরকার। এসব তো নাই বললেই চলে। তাই স্যালাইন চলছে, চলছে একটু পর পর প্রেসার মাপা। প্রেসারটা খুবই নীচে নেমে গেছে। ওকে নিয়ে ডাক্তারের ভয়ের জায়গাটা ঠিক এখানেই।

আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে ঊষা ডাকছে আমায়। স্যার! একটু উঠবেন! হাসপাতাল থেকে কল এসেছে। নানুর অবস্থা সিরিয়াস। এক্ষুণি যেতে হবে। আমি ধরমর করে উঠতে যাবো। অমনি ঊষার সতর্কতা। শব্দ করা যাবে না, স্যার! শব্দ করলেই ম্যাডাম জেগে যাবেন। টের পেয়ে যাবেন। কোনভাবেই ম্যাডামের ঘুম ভাঙানো যাবে না। তিনি খুবই অসুস্থ। প্রেসার খুবই উঠানামা করছে। নীচে নামতে নামতে একেবারে ৫০ এ নেমে যাচ্ছে।

পা টিপে টিপে আমি ঘরে হাঁটছি। বিড়ালের হাঁটার মত। এক পা ফেলে অন্য পা ফেলবো কি না ভেবে ভেবে হাঁটছি। যেন শোনিম এবং হিয়ার ঘুম না ভাঙে। শোনিম টের পায়নি। কিন্তু হুরমুর করে হিয়া জেগে উঠেছে। ভার্সিটিতে পড়া মেয়ে আমার হিয়া। মেয়েই তো। ভাইয়ের মেয়ে, মেয়ে নয় তো কি! আঠার মত লেগে থাকে সারাক্ষণ। ওর লক্ষ্য একটাই; কোনভাবেই আমাকে অসুস্থ হতে দেয়া যাবে না। ও আমার নিত্যদিনের সঙ্গী। সঙ্গী দিনের, সঙ্গী রাতের। ক’দিন ধরে মাথার পাশে ছোট্ট বিছানা পেতে রাতভর পাহারা দেয় আমায়।

হিয়ার সাহায্য নিয়ে কোন রকমে গাঁয়ে সামান্য কাপড় জড়িয়ে ফজরটা সেরে নিলাম। দরজা পর্যন্ত হিয়াই এগিয়ে দিল। বাইরে তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ী বারান্দায় আমাদের রুমান দাঁড়িয়ে। চোখে বেজায় টেনশান তার। নানুর খারাপ কোন কিছু হয়ে গেল কিনা এই ভয়েই রুমান দিকবিদিক শূন্য। শোনিমের নানু এই পরিবারের সবার নানু। তাই শুধু রুমান নয়; সবাই তটস্থ, সন্ত্রস্থ। সবাই নানুকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। হাসপাতালের রিসিপশনেও একই অবস্থা। লোকজনে ভরে গেছে রিসিপশান। যাদের রাতের ডিউটি নেই, তারাও উপস্থিত। উপস্থিত আমাদের প্রতিষ্ঠানের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও।

আইসিইউর একেবারে শেষ কর্ণারের বেডে গভীর কোমায় শুয়ে আছেন চোখবন্ধ আমার শাশুড়ী মা। যেন এইমাত্র ঘুমুতে গেলেন। দেহখানি নিথর, নিস্তব্দ। ভোররাতের দিকে একসাথে দুটো এট্যাক হয়েছে তাঁর। একটা হার্টে, অন্যটা ব্রেন এ। অবস্থা খুবই সিরিয়াস। আগে থাকতেই বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে কেবিনে ভর্তি ছিলেন তিনি। কেবিনে থাকতেই আইসিইউ থেকে ভেন্টিলেটর এনে তৎক্ষণাৎ লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়েছে তাঁকে। তবুও কোমা থেকে ফেরানো যায়নি। গভীর কোমা। সবাই প্রচন্ড রকমের চেষ্টা করেছে। তাৎক্ষনিক চিকিৎসার অত্যন্ত আধুনিক সব ব্যবস্থা আমাদের হাসপাতালে আছে বলেই সকল বন্দোবস্ত তাৎক্ষনিকভাবেই করা গেছে।

কিন্তু এতেও শেষকূল রক্ষা হয়নি। দিনকে দিন অবস্থা শুধু খারাপের দিকেই গেছে। শারীরিক অবস্থা মাঝেমধ্যে একটু ভালো হয়েছে বটে কিন্তু দিন না পেরুতেই আবার খারাপ হয়েছে। এ যেন ভাল আর খারাপের ওঠানামার খেলা। যেন ভাল আর খারাপের যুদ্ধ। জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর যুদ্ধ। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা নিকটজনেরা করে গেছি চেষ্টার পর চেষ্টা। মূল চেষ্টা করেছেন চিকিৎসকবৃন্দ। স্বনামধন্য চিকিৎসক নিয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড সাধ্যমতচেষ্টা চালিয়েছেন। এমন কোন অলটারনেটিভ নেই যেটা তারা গ্রহণ করেননি।

কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। গভীর কোমা থেকে তাঁকে আর ফেরানো যায়নি। এক পর্যায়ে আশা ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তারগণ। কিন্তু আমাদেরকে বুঝতে দেননি। নিজেদের মধ্যে ফিসফিস আলাপ করেছেন বটে কিন্তু আমাদেরকে সামান্য ছিটেফোঁটা বলতেও ইতস্তত করেছেন। তাদের মুখ বলছিল আশা ক্ষীণ। কিন্তু কর্ম বলছিল সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সেই আশায় বুক বেঁধে আমরা অপেক্ষায় থেকেছি ঘন্টার পর ঘন্টা।

আশায় আশায় তাদেরকে এসিস্ট করা জুনিয়র ডাক্তার, নার্স এবং বাদবাকী সেবিকাগণ খেটে গেছেন দিবানিশি। শুধু খাটেনি। নিজেদের চোখের পানিও অগোচরে নিজেরাই মুছেছে। শোনিমের নানুকে কখন যে ওরা সবাই নিজেদের নানু করে নিয়েছে কেউ বুঝেনি। নিজেদের ক্লান্তিকে গুরুত্ব দেয়নি, শ্রান্তিকে পাত্তা দেয়নি। একপায়ে দাঁড়িয়ে খেটে গেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো কোন কিছুতেই না শব্দটি বলেনি।

কিন্তু শেষমেষ হেরে গেছে। সারেন্ডার করতে হয়েছে। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে লাইফ সাপোর্ট মেশিনে থাকা অবস্থাতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মেশিন খুলে ফেলার কথা ছিল বিকেল পাঁচটায়। কিন্তু তিনি সে সুযোগ দেননি। আমাদের খুলে ফেলার আগেই বেলা সাড়ে তিনটায় তিনি চির বিদায় নেন। তাঁর বেহিসাবী বিদায়ে মনে হচ্ছিল, যেন তিনি নন; একটি পরিবারের সবচেয়ে দামী মানুষটির বিদায় হলো। সবচেয়ে দামী নক্ষত্রের পতন হলো!

তিনি তো বিদায় নিলেন। এবার তাঁকে বিদায় দেবার পালা আমাদের সবার। গোসল, কাপড়, কাফন! আরো কত কি! আতর, গোলাপ, গরম জল; সব ব্যবস্থা হলো। এলাকার বেশ পরিচিত এবং বিদায়ী গোসলে কঠিন দক্ষ মানুষটিকে আনা হলো। এসেই তিনি সব শুরু করে দিলেন। মরহুমার ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর দুই পুত্রবধু পাশে থাকলো। সর্বোপরি একেবারে সামনে থেকে সবকিছু তদারক করলো মরহুমার মেয়ে আমার শোনিমের মা।

কর্পূরের গন্ধে চারিদিক ভারী হয়ে উঠছে। সাদা কাফনের মোড়কে মাকে এনে রাখা হলো ফ্রিজিং এম্বুলেন্সে। প্রচন্ড ঠান্ডা এম্বুলেন্সটি ছোট্ট ছোট্ট তুষার কণায় খুবই ধীরলয়ে মাকে ঢেকে দিচ্ছিল যেন শেষ বিদায়ের শেষক্ষণটি পর্যন্ত তিনি অক্ষত এবং অবিকল একই রকম থাকেন। এদিকে লোকজন আসতে শুরু করেছে এবং ভরে যাচ্ছে তাঁর এম্বুলেন্সের চারপাশ। চেনাজানা আত্মীয়স্বজনে হাসপাতালের লবীতে আর ঠাঁই নেই। শেষ বিদায়ের প্রস্তুতিতে সবাই শোকাতুর। কান্নার রোল থেমে থেমে আসছে এদিক ওদিক থেকে। সবাই কাঁদছে।

শুধু কাঁদেনি আমার ধরনী। কাঁদতে পারেনি। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলেও বৃষ্টি হয়নি। বসন্তের আবহাওয়া বেশ ভাল ছিল। ঝিরঝিরে বাতাসে বাসার নীচতলার আঙিনায় মায়ের কফিনের পাশে বসে হাফেজগণ রাতভর কোরআন তেলওয়াত করেছেন। আর আমরা করেছি শবযাত্রার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এবার যাত্রার পালা। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রওনা দিতে হবে। যেতে হবে গ্রামের বাড়িতে। বহুদূর, বহু পথ!

ফজরের জামাত শেষে গাড়ির বহর যাত্রা শুরু করলো। একটার পর একটা গাড়ি বেরুচ্ছে। এবার মাকে বহনকারী গাড়ির পালা। তিনি কেবল আমার শাশুড়ী মা নন, তিনি আমার খালাও। আমার মায়ের আপন ছোট বোন। গাড়ি বহরের ঠিক মাঝের গাড়িতে মাকে বহনকারী এম্বুলেন্স। আস্তে আস্তে ওটাও রাস্তায় নামলো। নিথর, নিস্তব্দ দেহখানী কিচ্ছু বুঝছে না, কিচ্ছু জানছে না। জানছে না এটাই তাঁর শেষ বিদায়!

একদিন যে বাড়ি ছিল তাঁর পদচারণায় মুখরিত, চিরজীবনের জন্যে সে বাড়ি ছেড়ে তিনি আজ চলে যাঁচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন অনন্ত অসীমের পানে! আর কোনকালে এ বাড়িতে তাঁর ফিরে আসা হবে না! পড়বে না তাঁর পায়ের চিহ্ন এ বাড়িতে! থাকা হবে না এ বাড়িতে তাঁর নিজস্ব কক্ষে! কক্ষের দেয়ালে ছবির ফ্রেমে বাঁধা হয়ে তিনি থাকবেন আজীবন! আপনজনার ভীড়ে! আপনার নীড়ে!!! চলবে….