বিশেষ প্রতিবেদক ।। “আমি সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাই না, জনগণের মাঝেই আমার নিরাপত্তা।”-’৯৩-র ৯ জানুয়ারি বিদেশে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে লাখো জনতার গণসংবর্ধনায় মৃত্যুঞ্জয়ী মেননের দৃঢ় উচ্চারণ। জাতীয় প্রেসক্লাবের এ দিনের সমাবেশে জনতার ভালোবাসায় আবেগে আপ্লুত মেনন দেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন, “ দেশের মানুষ আমাকে রক্তের ঋণে আবদ্ধ করেছেন। আজীবন জনতার লড়াইয়ে’ই থাকব।” রাজনীতির কিংবদন্তী কমরেড মেনন তাঁর কথা রেখেছেন। আজো আছেন জনতার কাতারে। লড়ছেন মানুষে জন্য, মানুষের সংগ্রামে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়ে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, উগ্র মৌলবাদী তাণ্ডব,সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কিংবা সরকারের গণবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সংসদ থেকে রাজপথ-এক সাহসী কণ্ঠস্বরের নাম কমরেড রাশেদ খান মেনন।

আজ ১৭ আগস্ট জীবন্ত কিংবদন্তী এই ক্ষণজন্মা পুরুষের হত্যাচেষ্টার ৩০ বছর। দিনটিকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি পালন করে মেনন হত্যাচেষ্টা দিবস ও সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে। এবছর দলটির কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা এবং শাখা কমিটি পালন করছে নানা কর্মসুচী। কেন্দ্র ও ঢাকা মহানগর কমিটির উদ্যোগে রাজধানীর তোপখানা রোডে কেন্দ্রীয় দপ্তরের সামনের চত্বরে সকাল ১০ টায় আয়োজন করা হয়েছে রক্তদান কর্মসূচীর। বিকেল ৪টায় তোপখানা রোড থেকে বের হবে লাল পতাকা মিছিল। পল্টন মোড়, নুর হোসেন স্কয়ার, গোলাপ শাহ মাজার,বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, দৈনিক বাংলা মোড় হয়ে তোপখানা রোডে এসে শেষ হবে সেই মিছিল। জেলা-উপজেলায় আয়োজন করা হবে মানববন্ধন, আলোচনা সভা, বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ। এ তথ্য জানানো হয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে।

১৯৯২ সালের ১৭ আগস্ট। ইতিহাসের সেই ভয়াল দিনে ঘড়ির কাঁটায় রাত ৮টা ২৫ মিনিট। সাংগঠনিক কাজ শেষে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (বর্তমানে সভাপতি)কমরেড রাশেদ খান মেনন তোপখানা রোডের কেন্দ্রীয় পার্টি অফিস থেকে বের হন বাসার উদ্যেশ্যে। ঠিক তখনই কমরেড তাঁর ওপর গুলিবর্ষণ করে হায়েনার দল। বুলেটের আঘাতে বিদীর্ণ হয় মেননের বুক। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল-গুলিবিদ্ধ মেনন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। বাইরে প্রতীক্ষায় মানুষ হাজারে হাজারে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, একটাই উৎকণ্ঠা-কমরেড মেনন বাঁচবেন তো! অনেকের আকুল আর্তি-“প্রয়োজনে আমার দেহের সব রক্ত নেওয়া হোক, তবু প্রিয় নেতাকে জীবন্ত দেখতে চাই।” দেশজুড়ে মানুষের একটাই উচ্চারণ,“জনতার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হতে পারে না!” কমরেড মেননকে উন্নত চিকিৎসার উদ্যেশ্যে বিদেশ নেওয়া হয়।

২০ আগস্ট সারাদেশে এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ডাকা হয় হরতাল। সেদিন যে হরতাল পালিত হয়েছিলো তা ইতিহাসে বিরল। কোনো পিকেটিং ছিল না। তারপরেও রাস্তায় কোনো যানবাহন চলে নি। রাজপথে লাখো মানুষের প্রতিবাদ। সবার বিশ্বাস জনতার সংগ্রামে অবিচল মেনন মরতে পারেন না। তিনি ফিরবেন। মানুষের সংগ্রামে আবার তার কণ্ঠ সোচ্চার হবেই। অবশেষে লন্ডনের কিংস হাসপাতাল থেকে দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে কমরেড মেনন ফিরে আসলেন মাতৃভূমিতে। মানুষের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হলো মৃত্যুও। রাশেদ খান মেনন হয়ে উঠলেন মৃতুঞ্জয়ী কমরেড।

১৯৯৩ সালের ৯ জানুয়ারি কমরেড মেননের চিকিৎসা শেষে ফিরে আসার দিনে বিমানবন্দর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাব-পথে পথে লাখো মানুষের অভিবাদন। জনতার সামনে মেনন সেদিন যে ওয়াদা করেছিলেন তা আজো অক্ষুন্ন রেখেছেন। যে উদ্যেশ্যে হায়েনারা তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। তাদের সে উদ্যেশ্য সফল হয় নি। মৃত্যুঞ্জয়ী মেনন আবার সোচ্চার হন জনতার সংগ্রামে। গর্জে উঠেন সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী জঙ্গি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। যেখানে অন্যায়-অনিয়ম, যেখানে মৌলবাদী-জঙ্গি অপশক্তির ছোবল সেখানেই মেনন প্রতিবাদে সোচ্চার। ৩০ বছর পরেও সেই লড়াইয়ে এখনো আছেন অবিচল। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতি-লুটেরা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে কমরেড মেনন সংসদ ও রাজপথে লড়ছেন সমানতালে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংগ্রামে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু আপসোস, ৩০ বছর পরেও মেনন হত্যাচেষ্টাকারী সন্ত্রাসীদের বিচার হয় নি। আজো বিচারের দাবিতে পার্টি কর্মীদের রাস্তায় নামতে হয়। পার্টির তরফ থেকে এই হত্যাচেষ্টার পিছনে সেই সময়ের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাত রয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলেও পুলিশ দায়সাড়া তদন্ত করে কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে। পরে পার্টির তরফ থেকে পুনঃতদন্তের দাবি করলে অধিকতর তদন্তের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও তা আর আলোর মুখ দেখে নি।

শুধু কমরেড মেনন নয়, এই ৩০ বছরে সন্ত্রাসের নির্মম বলি হয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির বহু নেতাকর্মী। সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের আঘাতে ওই বছরের ২২ জুন প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন নাটোরের লালপুরের আখচাষী নেতা ও পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা কমরেড আব্দুস সালাম। সে হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় নি। ঘুরে বেড়াচ্ছে কমরেড সালামের খুনিরা। হত্যা করা হয়েছে কুলবিলা গুচ্ছগ্রামের পার্টি নেতা কমরেড উজির আলী, আশানুর পটুসহ আট ভূমিহীন খেতমজুরকে। নির্মম হত্যার শিকার হয়ে খুন হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের পার্টি নেতা কমরেড রফিক খান, চুয়াডাঙ্গার কমরেড জহির, প্রাক্তন জেলা সম্পাদক কমরেড রমজান আলী,  জেলা সম্পাদক মখলেসুর রহমান, ঝিনাইদহের মন্টু মাস্টার, বরিশালের উজিপুর উপজেলার পার্টির প্রাক্তন সম্পাদক কমরেড বাবুলাল শীল, রাজশাহীর শ্রমিকনেতা কমরেড মোহাম্মাদ আলী, পাবনার আব্দুর রশীদসহ বহু নেতাকর্মীকে। সন্ত্রাসের বলি হয়েছেন ছাত্র মৈত্রী’র শহীদ জামিল আকতার রতন, জুবায়ের চৌধুরি রীমু, ফারুকুজ্জামান ফারুক, দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপম, আয়ুব হোসেন, বনি আমিন পান্না, আসরাফুল ইসলাম নাসিম, আসলাম, আতিকুল বারী,  রাজু আহম্মেদ বাবলু, শামীম আহমেদ, রেজওয়ানুল ইসলাম  চৌধুরী সানিসহ সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী লড়াইয়ের বহু সাথী। গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে ২০০৬ সালে প্রাণ হারিয়েছেন যুব মৈত্রী’র সাথী শহীদ রাসেল আহমদ খান। এসব হত্যাকাণ্ডের কোনোটিরই বিচার হয় নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। এখন এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ বিচারের দাবিতে আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে-এমনটাই বলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।