Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি ব্রয়লার কারসাজি; দেড় মাসে হাজার কোটি টাকা লুট!

ব্রয়লার কারসাজি; দেড় মাসে হাজার কোটি টাকা লুট!

31

ডেস্ক রিপোর্ট: গত কয়েক মাস ধরে দেশের পোলট্রি খাতে চলছে অস্থিরতা। মুরগি ও ডিমের বাজার রীতিমতো লাগামহীন। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন মহল থেকে চেষ্টা করা হলেও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। এর মধ্যে আবার প্রান্তিক খামারিরাও অভিযোগ করে আসছেন তারা মুনাফা করতে পারছেন না। সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে উৎপাদন ও বাজার নিয়ন্ত্রণ মূলত একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে। তারাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক।
ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, বর্তমানে উৎপাদন খরচের দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। প্রতি কেজি মুরগির উৎপাদন খরচ ১২০-১৩০ টাকা হলেও বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৩০০ টাকা। এই পরিস্থিতিতে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে বৃহস্পতিবার তলব করে বাজারে পোলট্রির (ব্রয়লার মুরগি) অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চেয়েছিল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বৈঠকে যৌক্তিক দামের চেয়ে বেশি দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করলে এবং তা অব্যাহত থাকলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সীমান্ত খুলে দিয়ে মুরগি আমদানির সুপারিশ করার কথা জানায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। এদিকে গত বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআইয়ের বোর্ড রুমে মতবিনিময় সভায় মুরগি ব্যবসায়ীদের ডাকলেও তারা কেউ আসেননি মিটিংয়ে। পরে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা সরকারের কাছে আমদানি উন্মুক্ত করে দিতে বলবো। আগামী দু-তিন মাস আমদানি করা হোক। এছাড়া আর আমরা কোনো পথ দেখছি না।
তবে মুরগি আমদানির হুমকির প্রেক্ষিতে দেশের বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান-কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ এবং প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড ঘোষণা দিয়েছে পবিত্র রমজান মাসে তারা খামার থেকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রি করবে। গতকাল পয়লা রমজানে মাত্র একদিনের ব্যবধানে কেজিপ্রতি ২০-৩০ টাকা পর্যন্ত দাম কমেছে। গতকাল প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ২৬০-২৭০ টাকা দরে। যা একদিন আগেও ছিল প্রায় ৩০০ টাকা।
এদিকে সরকারি তদারকি না থাকায় দেশের পোলট্রি খাতে হরিলুট চলছে বলে অভিযোগ করেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। তাদের দাবি, এই খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। প্রান্তিক খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন কেজি প্রতি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়েছে। তাতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কেজিপ্রতি অন্তত ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করেছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের (তাদের চুক্তিভিত্তিক ফার্মসহ) মাধ্যমে প্রতিদিন দুই হাজার টন মুরগি বাজারে আসে। সেই হিসাবে দিনে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা হয় ১২ কোটি টাকা। এভাবে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে ৬২৪ কোটি টাকা মুরগি বিক্রির মাধ্যমে লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। আর এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের মুনাফা ৩১২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশে প্রতিদিন মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয় ২০ লাখ। এসব বাচ্চা কোম্পানিগুলো উৎপাদন করে। একেকটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হয় ২৮ থেকে ৩০ টাকা, যা চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ছিল ১০ থেকে ১৫ টাকা। প্রতিটি এখন ৬২ থেকে ৬৮ টাকায় দেওয়ার কথা হলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। প্রতিটি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করছে কোম্পানিগুলো।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, এত দিন দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো যখন চাপের মুখে পড়ল, তখন তারা ঠিকই দাম কমিয়ে বিক্রি করতে চাইছে। বিষয়টা এমন নয় যে তারা লোকসানে মুরগি বিক্রি করবে। তার মানে এটা স্পষ্ট, তাদের লাভের অংশ অনেক বেশি। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টির আরও অধিকতর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সুমন হাওলাদার বলেন, মুরগির কেজি ২০০-২১০ টাকা হলে ঠিক আছে। পোলট্রি খাতের করপোরেট কোম্পানিগুলো শতভাগ খাদ্য ও বাচ্চা উৎপাদন করে। আবার তারাই ডিম ও মুরগিও উৎপাদন করে।
কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিভিত্তিক খামারও কাজে লাগায়। এতে করে বাজার গুটিকয়েক কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে, যা বার বার ওঠা বাজার সিন্ডিকেটের অভিযোগের সত্যতাকে প্রমাণ করে। করপোরেট গ্রুপের মুরগি, ডিম, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে না পারলে কোনোদিন বাজার সিন্ডিকেট বন্ধ হবে না। বর্তমানে বাচ্চার দাম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও সংকট দেখিয়ে এ বাচ্চা এখন ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন,তারা তাদের মর্জিমাফিক খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার যারা কন্ট্রাক্ট ফার্মিং করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ও বাচ্চা দুটোর দামই অনেক কম রাখে। এতে যারা তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ তারাই শুধু টিকে থাকে। বাকি যারা প্রান্তিক খামারি আছে তারা সবাই খামার বন্ধ করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. বাপন দে বলেন, পোলট্রি খাত অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। দিন দিন পোলট্রি খাতে প্রান্তিকদের হার কমে যাচ্ছে। অপরদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদনের হার বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাজারের মূল্যের পেছনে তাদের ভূমিকা দিনদিন বাড়ছে।

নীতিমালা অনুযায়ী, একই সঙ্গে খাদ্য ও বাচ্চা উৎপাদনের পাশাপাশি কোম্পানিগুলো মুরগি ও বাচ্চা উৎপাদন করতে পারবে না। সরকারের ন্যাশনাল পোলট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি আছে। কে কী করতে পারবে সেটা সেখানে উল্লেখ আছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নে সরকার ও বেসরকারি সবারই সদিচ্ছার অভাব আছে। পোলট্রি খাতে খামারিরা অনেক সময় অনেক লোকসানও গোনেন। নীতিমালা চূড়ান্ত হওয়া প্রয়োজন। তাহলে বাজার এমন অসহনশীল হওয়ার কথা না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, পোলট্রি নীতিমালা প্রায় চূড়ান্ত অবস্থায় রয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে আসেনি। তবে পোলট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) দাবি করেছে মুরগির উচ্চমূল্য এবং বাজার অস্থিরতার জন্য মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট দায়ী।

কাজী ফার্মসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বলেন, আমরা পোলট্রি ব্যবসায়ীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের ফার্ম থেকে সরাসরি মুরগি বিক্রি করবো। ফার্ম থেকে মুরগি যাওয়ার পর কয়েক হাতবদল হয়, দাম বেড়ে যায়। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি উৎপাদন বাড়াব, তাতে দাম একটু কমবে বাজারে।

কয়েকটি কোম্পানিই নিয়ন্ত্রক!:মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি খাদ্যের (ফিড) সিংহভাগ উৎপাদন করছে কয়েকটি কোম্পানি। পাশাপাশি ডিম ও মাংসের বাজারেও বড় একটি অংশ তাদের দখলে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি চুক্তির ভিত্তিতে কোম্পানির বাইরে অন্য অনেক খামারিকেও কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো। বাজারের আকৃতি, মুনাফাসহ ব্যবসায়িক বিভিন্ন তথ্য প্রকাশের বিষয়ে কোম্পানিগুলো বরাবরই এক ধরনের গোপনীয়তা বজায় রাখে। কোম্পানিগুলোর দাবি, ডিম ও মাংসের বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ১০-১৫ শতাংশের বেশি হবে না। যদিও খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পোলট্রি পণ্যের বাজারের সিংহভাগই কোম্পানিগুলোর দখলে। বলতে গেলে বাজারের গতিপ্রকৃতি তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে। পোলট্রি বাজারে বর্তমানে যে কয়টি প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবশালী হিসেবে দেখা হয় সেগুলো হলো কাজী ফার্মস গ্রুপ, নারিশ, প্যারাগন, আফতাব, কোয়ালিটি, প্রোভিটা, সিপি, ডায়মন্ড এগ, রাশিক-জামান গ্রুপ ইত্যাদি। পোলট্রি খাতে মাংস ও ডিমের জন্য মুরগির একদিন বয়সী বাচ্চা ক্রয় করে থাকেন খামারিরা। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এসব বাচ্চা যেসব মোরগ-মুরগির মাধ্যমে উত্পাদন হয়; সেগুলোকে বলা হয় প্যারেন্ট স্টক (পিএস)। আর পিএস উৎপাদন হয় গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টক (জিপি) থেকে। দেশে জিপি ও পিএসের বাজারের পুরোটাই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। প্রান্তিক খামারিদের অভিযোগ, পোলট্রি খাতে কোম্পানিগুলো একই সঙ্গে বাচ্চা, খাদ্য, ডিম ও মাংস উৎপাদন করছে। এতে তারা ইচ্ছেমতো বাচ্চা ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও হ্রাস করার সুযোগ পাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে তারা মুরগি ও ডিম উৎপাদন করছে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে। এ কারণে বাজারের নিয়ন্ত্রণও প্রধানত এসব কোম্পানির হাতেই থাকে।
ইত্তেফাক