Home মতামত বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন এমন পরিচালনা পরিষদ?

বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন এমন পরিচালনা পরিষদ?

49

সরদার মোঃ শাহীন
বয়স যখন আমার সবেমাত্র পাঁচ পূর্ণ হয়, দেশটিও আমার ঠিক তখনই স্বাধীন হয়। পাকিস্তানী আমলের পরাধীনতার যাতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে বাঙালী পুরোপুরি বিজয়ের স্বাদ অনুভব করে। জাস্ট পাকিস্তানী আমলের মাত্র পঁচিশ বছরের পরাধীনতা নয়, হাজার বছরের পরাধীনতা থেকে মুক্তির স্বাদ অনুভব করে। অনুভব করে বিজয়ের স্বাদ। চারিদিকে শুরু হয় বিজয় ধ্বনি। বিজয়ের মাসে তুমুল বিজয় ধ্বনি।
বিজয়ের মাসটা বিজয় আর আনন্দ মিছিলে পার করেই বাবা আমায় সদ্য স্বাধীন দেশের স্কুলে ভর্তি করার কথা বললেন। এর আগে স্কুল শব্দটা কোনদিনও শুনিওনি। যেমনি শুনিনি, তেমনি বুঝিওনি স্কুল কাকে বলে। বাবা বুঝিয়ে দিলেন। কিচ্ছু না বুঝেও আমি বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়ে বোঝার ভান করলাম এবং জানুয়ারীর শুরুতেই স্কুলে ভর্তি হয়ে দুটো বই (বাংলা-অংক) বগল দাবা করে নিত্যদিন স্কুলে যাতায়াত শুরু করলাম।
অনেকটা নাচতে নাচতে যাতায়াত যাকে বলে। যেমন তেমন কথা! স্কুলে যাওয়া বলতে কথা! স্কুলে যাচ্ছি মানে কোন কিছু একটা যেন উদ্ধার করতে যাচ্ছি। তবে স্কুল বলতে তেমন কিছুই না। বাসার চেয়েও দারুণ মজার এক জায়গা মাত্র। এক মহা আনন্দের মিলন মেলা। সারাক্ষণ শুধু দৌঁড়াদৌঁড়ি, খেলাধূলা আর বিজয়ের গান গাওয়া। মাঝেমাঝে মিছিল মিছিল খেলা। শ্লোগানে শ্লোগানে, মিছিলে মিছিলে স্কুলের এপাশ থেকে ওপাশে যাওয়া। জয় বাংলা, বাংলার জয় আর তোমার নেতা আমার নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শ্লোগান দিয়ে দিয়ে স্কুলের পুরো সময়টা পার করা।
তবে ফাঁক দিয়ে দুটো ক্লাশও হতো। বাংলা আর অংক ক্লাশ। ওখানেও মজা ছিল। সুরের আর জোরের মজা। ছড়া এবং কবিতা পড়তাম সুরে সুরে আর নামতা গোনতাম জোরে জোরে। গুনে গুনে ক্লাশ ফাটিয়ে ফেলতাম। তবে শুধু নিজে নিজে নামতা গুনতাম তা নয়; সবাইকে নামতা শিখাতামও। ছুটির সময় মাঠে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সবাই নামতা শিখতো। শুধু আমার ক্লাশের নয়; উপরের ক্লাশেরও। স্যার আমাকে স্কুল ভবনের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে বলতেন, নে! ধর। জোরে জোরে নামতা ধর। আমি ধরতাম, দুই এককে দুই।
তবে এমনিতর মজাগুলো বেশিদিন টিকেনি। ক’দিন যেতে না যেতেই পরিস্থিতি গুমোট হতে লাগলো। চারিদিকে মিছিল মিটিং শুরু হতে লাগলো। ঠিক বিজয় মিছিল না। লাঠি মিছিল, মশাল মিছিল। রাতের অন্ধকারে লুটপাটও শুরু হলো। ব্যাংক লুট, গোডাউন লুট। এগুলো পলিটিক্যাল লুট। একদিন হঠাৎ বাসার সামনের ধলা রেলস্টেশন সিরাজ সিকদারের দল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। দাউদাউ করা আগুন। পুড়ে সব ছাড়খার হয়ে গেল।
ওদের দাবী একটাই; সরকারের পতন। সদ্য স্বাধীন দেশের সদ্য গঠিত সরকারের পতন। পতন চায় অবিসংবাদিত জনপ্রিয় জননেতা স্বাধীনতার জনকের। আন্দোলনের নামে শুরু হয়ে গেল অরাজকতা। গ্রাউন্ডে আন্দোলন, আবার আন্ডার গ্রাউন্ডেও আন্দোলন। আন্দোলনের নামে ধ্বংসাত্মক খেলা। প্রচন্ড রকমের অরাজকতা সৃষ্টির নোংরা খেলা। এভাবে অরাজকতা করে করেই ঠিক সাড়ে তিন বছরের মাথায় ওদের উদ্দেশ্য সফল হলো। নৃশংসভাবে স্বপরিবারে খুন করা হলো জাতির জনককে।
ক্ষমতার পালা হলো বদল। আর হলো অর্জন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আন্দোলনের তথাকথিত অর্জন। কিছুই না; জাস্ট ক্ষমতার পালা বদল। সেই যে শুরু, যার ধারা আজও বিদ্যমান। এই নামে সেই নামে দেশে শুধু আন্দোলন আর মিছিল চলছে। গেল পঞ্চাশটি বছর ধরেই চলছে। আন্দোলন চলছে ব্যক্তি বা দলগত দাবী দাওয়া নিয়ে, আন্দোলন চলছে কোন গোষ্ঠী বা সেক্টরের বেতন ভাতা বাড়ানো নিয়ে। কারো কারামুক্তি বা কারাভুক্তি নিয়ে চলেছে আন্দোলন। নামে গণতন্ত্রের আন্দোলন বলা হলেও মূলত ওসব ছিল শুধুমাত্র একদিনের নির্বাচনতন্ত্রের আন্দোলন। কোনদিনও দেশের জন্যে, দেশবাসীর ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্যে সরাসরি কোন আন্দোলন দেশে আজও হয়নি।
অর্থাৎ ঘুরে ফিরে যাই বলি সেসব শুধু ক্ষমতায় থাকা আর যাওয়ার আন্দোলন। এমনি আন্দোলনের অভাব নেই দেশে। কিন্তু আমার এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে দেশের ভালোর জন্যে আজও কোন আন্দোলন পাইনি। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের আন্দোলন দেখেছি কেবল। তবে এসব আন্দোলন দরকার হতো না যদি সব আন্দোলন ফেলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত মানোন্নয়নে শুধুমাত্র একটি আন্দোলন হতো।
আর যদি এই একটি মাত্র সফল আন্দোলন দিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে আমূলে বদলে ফেলা যেত তাহলে এ জাতি নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন নিজেই করতে পারতো। ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্যে তথাকথিত রাজনীতিবিদদের আর দরকার হতো না। দুঃখজনক ভাবে সেটা তো হয়ইনি বরং হয়েছে মহাক্ষতিকর উল্টো আয়োজন।
এরশাদ সাহেবের পতনের পর সেই আয়োজনের শুরু। এক অভিনব ব্যবস্থার আয়োজন। আজও দিব্যি ব্যবস্থাটি বিদ্যমান। এর আগ পর্যন্ত মোটামুটি বেশ ভালই ছিল। ৯১ সালে স্বৈরাচারকে হটিয়ে যেই না দেশে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার এলো অমনি সারাবাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা ঢুকে পড়লো। গণতন্ত্রের নামে গ্রামপর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের পেটভরার জন্যে আইন পরিবর্তন করে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথাকথিত পরিচালনা পরিষদ গঠন করে দেয়া হলো।
উদ্দেশ্য একটাই। কৌশলে দলের লোকজনকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে দেয়া। তাই লোক দেখানো কৌশলেই বলা হলো নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদ গঠিত হবে। তবে কমিটি প্রধানের বিষয়টিকে এর বাইরে রাখা হলো। পরিষদের সভাপতি নির্বাচনের মাধ্যমে আসবেন না। আসবেন সিলেকশনের মাধ্যমে। আর সিলেকশনের দায়িত্ব মূলত দেয়া হলো এলাকার সাংসদকে। সাংসদের একান্ত ইচ্ছায় তার নিজের লোক গদিটি পাবেন। পাশাপাশি আরও তিনটি পদেও আসবেন অনির্বাচিতরা। একজন শিক্ষক প্রতিনিধি, একজন শিক্ষানুরাগী সদস্য এবং একজন দাতা সদস্য।
বুঝুন অবস্থাটি। নির্বাচন হবে শুধুমাত্র তিনটি অভিভাবক সদস্য পদ নিয়ে। কমিটিতে যাদের কথা বলার সামান্য সুযোগও নেই। যা করার কিংবা সিদ্ধান্ত যা নেবার সব অনির্বাচিতরাই মিলেমিশে নেবে। কেননা সংখ্যায় তারাই তো ভারী। নির্বাচিত তিনজন সদস্য জাস্ট শো-পিস। তাদের কেবল একটাই কাজ। নিয়মিত মিটিং এ আসা এবং মিটিং এ বসে বসে শুধু চা খাওয়া আর এদিক ওদিক তাকিয়ে চোখ বুজে কাগজে সই করা।
তবে পরিষদ গঠন নিয়ে আইনে যাই থাক, এসব অরাজকতা এমন নেক্কারজনক ভাবে হতো না যদি এলাকার সাংসদ সঠিক কাউকে সভাপতি বানাতেন। কিভাবে বানাবেন! তাদের চোখে এলাকায় টাউট-বাটবার ছাড়া আর কোন ভাল লোক, সঠিক লোক তো কখনোই চোখে পড়েনা। চোখে পড়ে না কোন শিক্ষিত লোক। শুধু চোখে পড়ে এলাকার সবচেয়ে কম শিক্ষিত, কম পড়াশুনা জানা অর্ধশিক্ষিত অখাদ্যদের।
সারা এলাকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তারা নুন্যতম একজন গ্রাজুয়েট পান না, যাকে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি কিংবা ব্যবস্থাপনা পরিষদের সভাপতি করা যায়। অথচ তারাই আমাদের আইন প্রণেতা, সাংসদ। একটা জাতির জন্যে এরচেয়ে দূর্ভাগ্যের কিংবা কলংকের আর কি হতে পারে? তাদের ব্যর্থতায় শতশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতশত সভাপতি নিয়োগ পান, যারা চোখ বুজে গভর্নিং বডি কিংবা ম্যানেজিং কমিটি শব্দগুলোর সঠিক বানানও লিখতে পারেন না। কিংবা পারেন না এই শব্দগুলোর সঠিক বাংলা অর্থ বোঝতে। অর্থ বুঝবেন কী! সারা বাংলায় অনেক বেসরকারী কলেজ আছে যার সভাপতি কোনদিন কলেজেই পড়েননি।
কলেজে কোনকালে না পড়লেও এরা বাণিজ্য বোঝে। এরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢোকে মূলত বাণিজ্য করার জন্যে। নিয়োগ বাণিজ্য, ঘুষ বাণিজ্য, তহবিল তছরূপ বাণিজ্য ইত্যাদি। এছাড়াও এদের অন্যতম লক্ষ্য থাকে প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ভূমিসহ নানা ধরণের সম্পদ কুক্ষিগত করা। পাশাপাশি রাজনীতিতে আরো বড় পদে তরতর করে ওঠার জন্যে প্রতিষ্ঠানটিকে সিঁড়ি হিসেবেও ব্যবহার করে।
আসুন না যারা আমরা রাজনীতি সচেতন, দেশকে নিয়ে সারাক্ষণ ভাবি; ভাবতে ভাবতে ঘুম হারাম করে ফেলি তারা অন্তত এটা নিয়েও একটু ভাবি। একটু কাজ করি। লাগলে আন্দোলনও করি। লাগাতার আন্দোলন। কত আন্দোলনই তো করলাম জীবনে। এবার না হয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ব্যবস্থাপনা পরিষদ নিয়ে একটা কঠিন আন্দোলন করলাম। দেশ তথা জাতির মেরুদন্ড শক্ত করার আন্দোলন।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে বাঁচাতে হলে, দেশটাকে এগিয়ে নিতে হলে এর যে কোন বিকল্প নেই। এবং মোটেও আর বসে থাকার সময় নেই। কাল বিলম্ব না করে খুব তাড়াতাড়ি বিদ্যমান আইনটি বদলে ফেলা দরকার। শিক্ষা ব্যবস্থাকে সঠিক পথে চলতে দেয়া দরকার। শিক্ষিতদের হাতে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দেয়া দরকার। না হলে দিনে দিনে শেষ হয়ে যাবে দেশের শিক্ষাঙ্গন। একটা দেশের শিক্ষাঙ্গনটাই যদি শেষ হয়ে যায়, ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর বাকী থাকে কী বলতে পারেন!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।