Home মতামত বিশ্ব এভিয়েশন : প্রি-কোভিড, কোভিড ও কোভিড পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

বিশ্ব এভিয়েশন : প্রি-কোভিড, কোভিড ও কোভিড পরবর্তী চ্যালেঞ্জ

37

মোঃ কামরুল ইসলাম:
বিশ্ব এভিয়েশন সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এগিয়ে চলার পথে একটি বিশাল চালিকা শক্তি। কোভিড-১৯ পূর্ববর্তী ৯/১১ কিংবা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দাই ছিলো সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব এভিয়েশনের সবচেয়ে বড় দূর্যোগ। গত প্রায় তিন দশক এভিয়েশন শিল্পের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে জেট ফুয়েলের দামের অস্থিরিতা উল্লেখযোগ্য। আয়ের সাথে ব্যয়ের অসামঞ্জস্যতার কারনে বিশ্ব এভিয়েশন থেকে অনেক এয়ারলাইন্সকে হারিয়ে যেতে হয়েছে।

এভিয়েশন শিল্প নিজেই একটি বিশ্ব। এর রয়েছে একটি বিশাল কর্মীবাহিনী। কোভিড -১৯ এর মহামারীর পূর্বে এ সেক্টরটি বড় প্রবৃদ্ধির জন্য নির্ধারিত ছিলো। মহারীরর প্রভাবে এর আয়, প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট রকম হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব থাকার পরও বর্তমানে এটি পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে। আশা করা যাচ্ছে কয়েক বছরের মধ্যে মূল স্রোতে ফিরে আসতে পারবে।

কোভিড-১৯ মহারীরর বিস্তৃতি লাভের পর ২০২০ সালে সারা বিশ্বের আকাশপথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এয়ারলাইন্স শিল্পের গতিশীলতা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ছিলো, যেকোনো শিল্পের গতিশীলতা বজায় রাখতে হলে আকাশপথের গতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।

২০১৮ সালে এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাকশন গ্রুপের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বিগত কয়েক বছর বৈশ্বিক বিমান চলাচলের মার্কেটের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ ইতিবাচক ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সেই সময়ে, বৈশ্বিক বিমান পরিবহন খাতে ৬৫.৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান ছিলো এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ২.৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পৃক্ততা ছিল। এছাড়া প্রতিবেদনে মুক্ত-বাণিজ্য পদ্ধতি বিমান পরিবহনের বৃদ্ধিকে আরও সাহায্য করবে এবং এটি ২০৩৬ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ৫.৭ ট্রিলিয়ন ডলার রেকর্ড করবে, যেখানে প্রায় ৯৭.৮ মিলিয়ন মানুষের কর্মসংস্থান ঘটাবে।

বিগত কয়েক দশক ধরে এয়ারলাইন্সগুলোতে বেশ কিছু অস্থিরতা কিংবা চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক মন্দার সাথে লড়াই করা থেকে শুরু করে সরকারী নিয়মকানুন, সন্ত্রাসবাদ থেকে শ্রমের ঘাটতি সর্বশেষ কোভিড-১৯ মহামারী , এই খাতটি নানাবিধ অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।

জেট ফুয়েলের প্রাপ্যতা ও মূল্য নির্ধারণ:

এভিয়েশন শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করছে জেট ফুয়েল। গত প্রায় তিন দশক ধরে এই শিল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করছে জেট ফুয়েলের প্রাপ্যতা ও মূল্য নির্ধারণ। উচ্চ জেট ফুয়েলের দাম এয়ারলাইনের আর্থিক পোর্টফোলিওতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। প্রতি বছর এয়ারলাইন কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, জ্বালানির দাম সর্বকালের সর্বোচ্চে ছিল। ফলে এয়ারলাইন্সগুলোকে টিকে থাকা অনেক বেশী কষ্টসাধ্য ছিলো। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দার সময় এক লিটার জেট ফুয়েলের দাম সর্বোচ্চ ১.০৮ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিলো। সেই সময় সারা বিশ্বে অনেক এয়ারলাইন্স কোম্পানী নিজেদের ব্যবসাকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। বাংলাদেশ এভিয়েশনে নবগঠিত দুটি এয়ারলাইন্স বেস্ট এয়ার ও এভিয়ানা এয়ারাওয়েজ অনেকটা শুরুর আগেই শেষ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। তারই ফলশ্রুতিতে জিএমজি এয়ারলাইন্সেও প্রভাব পরে। তারই চূড়ান্ত পরিনতি ঘটে ২০১২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।

৯/১১ মূর্তিমান আতংকের নাম (সন্ত্রাস):

অতীতের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো বিশেষ করে ৯/১১ মূর্তিমান আতংকের নাম। ঘটনাগুলো শুধু জনসাধারনের মধ্যেই নয় বিমানবন্দরের কর্মীদের মধ্যেও ভয়-আতংক তৈরী করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিমানবন্দর কিংবা এভিয়েশন কেন্দ্রিক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নাই বললেই চলে তবে এখনও অনেকটাই হুমকি, কারন এয়ারলাইন কোম্পানীকে ধারাবাহিকভাবে সতর্ক থাকতে হয়। সন্ত্রাসবাদের ভয় বৃদ্ধির ফলে কঠোর চেক-ইন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে হয়। প্রত্যেকটি বিমানবন্দরে ৩ থেকে ৪টি নিরাপত্তা চেক সম্পন্ন করতে হয়। এর ফলে দীর্ঘ লাইন ও বিলম্ব হয়। চেক-ইন করার সময় থেকে প্রতিটি ধাপে উচ্চ নিরাপদ অত্যাধুনিক স্ক্রিনিং পদ্ধতি ও সরঞ্জাম বসানো হয়েছে প্রতিটি বিমানবন্দরে। এয়ারলাইনগুলো দুটি দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে আবার দুদেশের মধ্যে বিবাদের কারনও হতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড রোধ করার জন্য সরকারী বিধিবিধানগুলো এয়ারলাইন ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে সব সময়ই পরিপালনে সচেষ্ট থাকতে হয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার প্রভাব:

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, এভিয়েশন শিল্পের উপর একটি বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলেছিল। বৈশ্বিক অর্থনীতির পতনের সাথে সাথে ভ্রমণ এবং জ্বালানী খরচ বৃদ্ধি পায়, তখন যাত্রী সংখ্যা হ্রাস পায়। পর্যটন খাতে মন্দার প্রভাবও এয়ারলাইন শিল্পকে প্রভাবিত করার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কারণ। এয়ারলাইন কোম্পানীগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন রুট সম্প্রসারনের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে। বিভিন্ন অঞ্চলের মার্কেটের অবস্থা ও অস্থিরতার কথা হিসেবে রাখতে হয়। অর্থনৈতিক মন্দা, হোক বিশ্বব্যাপী অথবা অঞ্চলব্যাপী দুটোই এভিয়েশনের উপর চরম অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরী করতে পারে।

আরামদায়ক যাত্রীসেবা ও নানাবিধ অভিজ্ঞতা:

এভিয়েশন একটি সেবাধর্মী ব্যবসা। এর সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে যাত্রীরা কতটুকু সন্তুষ্ট তার উপর। যাত্রীদের একটি অংশ সবসময়ই অসন্তুষ্ট হতে পারে। এয়ারলাইন কোম্পানীগুলোকে সর্বত্র যাত্রী সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে থাকে। ইনফ্লাইট সার্ভিস, আরামদায়ক আসনব্যবস্থা, আধুনিক রিজার্ভেশন সিস্টেম, চমৎকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সঠিক সময়ে লাগেজ সরবরাহ, বিমানবন্দরে ঝামেলাবিহীন চেক-ইনের ব্যবস্থা ইত্যাদি। সঠিকভাবে এই সেবাগুলো অর্জন করা বিভিন্ন ধরণের ধারাবাহিক লড়াই। গ্রাহক সমীক্ষা ও প্রতিক্রিয়া সর্বদায় যাত্রীদের বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সবসময় সুখকর হয় না। আইএটিএ এর ২০১৭ সালের জরিপে দেখা যায় যাত্রীদের সর্বশেষ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশের অধিক যাত্রী
খুশি ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে যাত্রীদের সন্তুষ্টির জন্য এয়ারলাইন্সগুলো সর্বোতভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বিমানবন্দরের অবকাঠামো:

বিমানবন্দরগুলিকে অবশ্যই তাদের অবকাঠামোকে ধারাবাহিকভাবে আপগ্রেড করতে হবে – রানওয়ে, টার্মিনাল, কনকোর্স, হোটেল, শপিং সেন্টার, লাউঞ্জ এবং আরও অনেক কিছু। ফলে যাত্রী সন্তুষ্টি বাড়বে, যাত্রী সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।

এয়ারলাইন অবকাঠামো:

এয়ারলাইন্সের সুনাম বজায় রাখতে এবং প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার জন্য, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সিস্টেমের মতো অনসাইট সুযোগ-সুবিধাগুলি পর্যায়ক্রমে সংস্কার করা প্রয়োজন। এতে যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, প্রতিবার আপগ্রেডের পুনরাবৃত্তি এয়ারলাইন কোম্পানির আর্থিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।

এয়ারক্রাফ্টগুলিকে পর্যায়ক্রমে আপগ্রেড করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরী। কারণ যাত্রী নিরাপত্তা এর উপর নির্ভরশীল। এয়ারলাইন অবকাঠামো হল এভিয়েশন মার্কেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি। এয়ারলাইন কোম্পানীকে বর্তমান বহর বজায় রাখতে হবে এবং জ্বালানি দক্ষতা এবং কম খরচ নিশ্চিত করার সাথে সাথে নতুন ও আধুনিক এয়ারক্রাফট ক্রয়ও নিশ্চিত করতে হবে।

এয়ার ট্রাফিক ও বিমানবন্দরে জট:

এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ এখন আর সৌখিনতার বিষয় নয়। জনসাধারণ প্রয়োজনের তাগিদেই সময়কে সাশ্রয় করার জন্যই বিমান ভ্রমণ করে থাকে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন এয়ারলাইন কোম্পানী এবং প্রয়োজনের তাগিদে নতুন নতুন এয়ারক্রাফট বহরে যোগ করছে এয়ারলাইন্সগুলো। ফলে বিমানবন্দরের অবকাঠামো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন করা সম্ভব না বলে বিমানবন্দরে ও আকাশে এয়ারজট লেগেই আছে। এর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই এয়ারলাইন্স কোম্পানীগুলো যাত্রীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি:

প্রযুক্তিগত উন্নয়নগুলি এয়ারলাইন শিল্পের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। যেকোনো প্রযুক্তির প্রয়োগ দুই ধরণের উদাহরণ নিয়ে আসতে পারে। এটি যেমন বিপ্লব এনেছে তা সত্ত্বেও, এর উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা সমগ্র শিল্পকে দুর্বল করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সফ্টওয়্যার সমস্যার ক্ষেত্রে, এটি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এয়ারলাইনটির কার্যক্রম বিকল হতে পারে। অপর্যাপ্ত তহবিলের ক্ষেত্রে, বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো আপগ্রেড করা অসম্ভব হতে পারে, যার ফলে পুরো সিস্টেমটি ভেঙে পড়তে পারে।

আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ:

কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া, কালবৈশাখীর মতো ঝড়ের তান্ডব, বরফ বেষ্টিত সময় এয়ারলাইন্সকে চরম চ্যালেঞ্জের মুখে পরতে হয়। সিডিউল ব্যবস্থাপনায় দূর্যোগ দেখা দেয়।

মনুষ্যসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক সৃষ্ট যে কোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করেই বিশ্ব এভিয়েশন এগিয়ে যাচ্ছে। এভিয়েশনের গতিশীলতা যেমন বিশ্বের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বজায় রাখতে সহায়তা করছে তেমনি আবার অন্যান্য শিল্পের গতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করছে। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে সারাবিশ্বময় কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব উল্লেখ করা যায়।- লেখক: মহাব্যবস্থাপক, জনসংযোগ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।