Home জাতীয় বাড়ছে নবজাতক ফেলে দেওয়ার ঘটনা

বাড়ছে নবজাতক ফেলে দেওয়ার ঘটনা

50

ডেস্ক রিপোর্ট: পটুয়াখালীর গলাচিপায় নদীর ধারে কাপড় দিয়ে প্যাঁচানো এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার হয় গত শনিবার। গত পহেলা নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের শৌচাগার থেকে এক নবজাতককে উদ্ধার করা হয়। এর আগে গত ২৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পুলিশ আরও এক নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধার করে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশ আধুনিকতার দিকে যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে এ ধরনের ঘটনা। কারণ আধুনিকতা গতিশীল হলেও দেশে নেই তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি। তাই যৌনশিক্ষা বাধ্যতামূলক করাসহ এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেন তারা। কারা শিশুদের ফেলে দিচ্ছে তাও খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ৬ বছরে ২১০ জন নবজাতককে পরিত্যক্ত ও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এরমধ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই উদ্ধার করা হয় ২০ নবজাতকের মরদেহ। জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করা হয় বলে ফোরাম জানিয়েছে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে ছয়টি ছোটমণি নিবাসে ২০১৭ হতে ২০২১ পর্যন্ত চার বছরে ১০ হাজার ৮৯৮ জন পরিত্যক্ত শিশু আশ্রয় পায়। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিত্যক্ত শিশু পাওয়া যায় চট্টগ্রামে ৩ হাজার ১৬২ জন। তারপর সিলেটে ২ হাজার ৪৭৪ জন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা ১ হাজার ৫৩৬ জন। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, করোনাকালে পরিত্যক্ত শিশুপ্রাপ্তি চট্টগ্রামে ২১ শতাংশ, সিলেটে ১৯ শতাংশ এবং ঢাকাতে ২৫ শতাংশ বেড়েছে।

ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) ফারুক হোসেন জানান, পরিত্যক্ত শিশুকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পাওয়া গেলে প্রথমেই পুলিশে জানানো হয়। মৃত হলে নবজাতকের মৃতদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। তাদের ডিএনএ টেস্ট করা হয় না। কারণ এ ক্ষেত্রে কখনোই নবজাতকের প্রকৃত বাবা-মাকে পাওয়া যায় না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সনদ দেওয়া হলে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে পাঠানো হয় দাফনের জন্য। আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেলে আমরা নবজাতকের পাওয়ার খবর টিভি চ্যানেলে স্ক্রলে দিয়ে দেই। কোনো অভিভাবক না পাওয়া গেলে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে দেওয়া হয়।

উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হামিদা পারভীন বলেন, আমরা ১০টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং সমাজসেবা অধিদপ্তরের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করি। পরিত্যক্ত শিশু সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় পায়। নিঃসন্তান বাবা-মার ঘরেও তাদের জায়গা হয়।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, পরিত্যক্ত নবজাতকের বয়স এক বা দুই দিন হয়ে থাকে। তবে নবজাতক থেকে শুরু করে এক বছরের মধ্যেও অনেক শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, অনৈতিক সম্পর্ক এবং কিশোর-কিশোরীদের আবেগের ফলে জন্মানো এসব শিশুকে হাসপাতালে, ডাস্টবিনে, রেলস্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড এবং গণশৌচাগার থেকে পাওয়া যায়। যৌনশিক্ষা না দিলে এবং এ সম্পর্কে সচেতনতা না বাড়ালে পরিত্যক্ত নবজাতকের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়বে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘সনাতনী সমাজ থেকে আমরা আধুনিক সমাজে প্রবেশ করছি। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। তাই এ ঘটনাগুলো ঘটছে। তিনি বলেন, সনাতনী সমাজের কিছু নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, শর্ত ও মূল্যবোধ থাকে। সনাতনী যুগ যত গতিশীল হয়ে আধুনিক যুগে যাবে ততই এ সব নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ ভেঙে যাবে। আমাদের মূল্যবোধ সনাতনী সমাজ ও আধুনিক সমাজের যুগসন্ধিক্ষণে থাকার কারণে গর্ভপাতকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া হয় না। পুরুষ তান্ত্রিকতার কারণে পুরুষ দায়িত্ব নেয় না। প্রস্তুতি না নিলে এই ঘটনাগুলো নিশ্চিতভাবে বেড়ে যাবে। আমরা আধুনিক সমাজে বাস করলেও সনাতনী ও ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে অনেক কিছু মেনে নিতে পারি না। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।’

শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম মনে করেন, ‘আমরা যতই আধুনিক হই না কেন পরিবারকে সন্তানের দায়িত্ব নিতে হবে। মা-বাবা পেশার কারণে যত ব্যস্ত থাকুন না কেন জীবন সম্পর্কে সন্তানকে শিক্ষা তাদের দিতে হবে। যে শিশুদের ফেলে দেওয়া হচ্ছে, অনেক সময় তারা মারা যাচ্ছে—এটা অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত বয়োজ্যেষ্ঠদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ সে তার দায়িত্ব পালন করেনি বলে তরুণ-তরুণীরা ভুল পথে গেছে।’-ইত্তেফাক