Home মতামত প্রান্তজনের জেল জীবনঃ ত্রয়োদশ কিস্তি

প্রান্তজনের জেল জীবনঃ ত্রয়োদশ কিস্তি

60

সাইফুল ইসলাম শিশির: ট্রেনিং শেষে বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় এসে যোগদান করে রাশেদ। গত ছয় মাস কঠিন শৃংখলার মধ্যদিয়ে সে ট্রেনিং কাল পার করেছে। বাম-ডানে তাকানোর কোন সুযোগ ছিল না। এক্কাগাড়িতে ঘোড়া জুড়ে দেবার আগে চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়া হয়। যেন ঘোড়া শুধু সামনে দেখতে পায়। ট্রেনিং কাল ঠিক তেমনি। কথায় আছে ‘কানা ঘোড়া সোজা দৌড়।’
হালিশহর চট্টগ্রামে ট্রেনিং কালে রাশেদ বিশেষ পারদর্শীতার স্বাক্ষর রাখে। ফায়ারিংয়ে পুরো ব্যাচের মধ্যে দ্বিতীয় এবং সেরা স্পোর্টস ম্যান এর খ্যাতি অর্জন করে। ভলিবল, ক্রিকেটে ছিল তার দুর্দান্ত পারফর্মেন্স। কর্তৃপক্ষ তার নাম বিডিআর জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করা জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করে।
৩০ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাশেদের ডিউটি পড়ে। ইতোপূর্বেই তার ট্রেনিংউত্তর ছুটি অনুমোদন করানো আছে। দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি যাওয়া হয়নি। বাবা-মা, ভাই- বোন সেই কবে থেকে পথ চেয়ে আছে। রাশেদের মনের ভিতর উঁকি দেয় কৈশোর যৌবনের দক্ষিণা জানালা- শাহাগোলা।
তিন দিনের ছুটিতে বাড়ি আসে। বাড়ি বলতে তাদের মাত্র ছয় শতক জমির উপর একখণ্ড ভিটেবাড়ি। ক্যানেস্তারা টিনের ছোট ছোট দুখানা ঘর, টালির তৈরী একচিলতে রান্না ঘর। বৃষ্টি বাদলে পানি চোয়ায়। জোড়া- তালি দিয়ে কোন মতো চলছে সেই কবে থেকে। বাড়ির পাশে এক টুকরো পতিত জমি আছে। রাশেদের ইচ্ছা এরপর ছুটিতে এলে সেখানে মাটি ভরাট করে ঘর উঠাবে।
মেঝেতে পাটি পেতে রাশেদ খেতে বসেছে। মা তার পাশে বসে খাবার তুলে দিচ্ছে আর বাতাস করছে। স্বল্প সময় করে বাড়ি আসার জন্য মায়ের অভিযোগ- অভিমানের যেন অন্ত নেই।
না আসলেই হতো? একদু’দিনে কোনটা রেখে কোনটা খাওয়াবো? এতো কম সময়ে কী আর ভালোমন্দ খাওয়ানো যায়? শুধু মায়া বাড়ানো।

  • চিন্তা করোনা মা! খুব শীঘ্রই আমি আবার আসবো। তখন যা খাওয়াতে চাও খাওয়াবে। মা শুনে আস্বস্ত হয়। এক ফাঁকে সে কথা উঠায় ‘ফরিদাকে নিয়ে তোমার মামানি এসেছিল কদিন আগে। “ফরিদা এখন দেখতে কী সুন্দর হইছে।” ফরিদা মায়ের পছন্দের তালিকায় প্রথমে আছে, তা অবশ্য রাশেদ জানে। রাশেদ মৃদু হেসে বলে, “তাই! সামনের ছুটিতে এসে ফরিদাদের বাড়ি বেড়াতে যাবো।” মায়ের চোখে তখন খুশির ঝিলিক। যেন একঝাঁক সাদা পায়রা আকাশে উড়ছে।
    রাশেদের ইচ্ছে ছিলো ব্রিজের উপর উঠে পানিতে ঝাঁপ দিবে। অথৈ জলে সাঁতার কাটবে। জাল ফেলে মাছ ধরবে। শাহাগোলা স্কুল মাঠে বন্ধুদের নিয়ে ক্রিকেট- ভলিবল খেলবে। সাঁঝের বেলা খেজুর গাছের হাড়ি নামিয়ে রস খাবে। সতীশের দোকানে বসে পাটালিগুড়ের সন্দেশ খাবে। চা নিয়ে বসে দেশাল আড্ডা হবে। সতীশ দা সব গুছিয়ে দোকানের ঝাঁপি ফেলার তাগাদা দিলে তবেই না আড্ডা ভাঙবে । চাঁদ ডুবে গেলে পা টিপে টিপে বাড়ি ফিরবে।
    অথচ সময় অভাবে এবার কিছুই করা হলোনা। দারুণ অতৃপ্তি নিয়ে কর্মস্থলে ফিরছে রাশেদ। মা-বাবাকে সান্ত্বনা দেয় ইলেকশনের ডিউটি শেষ করেই ছুটি নিয়ে সে আবার আসবে। সে আসা যে আর সহসাই হবেনা, বাবা-মা রাশেদ কেউই তা ভাবেনি।
    মায়ের জন্য ছিল এটি শেষ দেখা।
    চলবে —

১৫ জুন ২০২১ খ্রিস্টাব্দ
থানা রোড, সিরাজগঞ্জ।

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।