সঞ্জীব রায়: প্রমত্তা পদ্মার বুকে বাঙালির স্বপ্নপূরণের উৎসবের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেতুবিভাগ কর্তৃক মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় আয়োজিত সুধী সমাবেশে বক্তব্যের পর প্রথম ম্যুরালের উন্মোচনের মধ্য দিয়ে সেতুর উদ্বোধন করেন তিনি। এর আগে নিজের হাতে টোল দিয়ে তিনি সেতুতে উঠেন। এসময় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছিলেন তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল।
উদ্বোধনী সুধী সমাবেশের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চারনেতা ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও পনেরোই আগস্টের নিহতদের স্মরণ করেন। দেশ ও বিদেশে বসবাসরত বাংলার আপামর জনতার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ এই সেতু নির্মাণকালীন যারা মৃত্যুবরণ করেন তাদেরও স্মরণ করেন তিনি। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যে ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের মানসিক অত্যাচারের মধ্যে রাখা হয়েছিল তাদের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। নিজের মা-বাবার কথা স্মরণ করতে গিয়ে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ষড়যন্ত্রকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই সেতু শুধু একটি অবকাটামো নয়, এটি অহংকার, গর্ব, সক্ষমতা ও মর্যাদার শক্তি। এর সাথে জড়িয়ে আছে সৃজনশীলতা, সাহসিকতা, প্রত্যয়। তিনি বলেন, আমরা কখনো মাথা নোয়াবো না। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়ে গেছেন। তিনি বাংলার মানুষের মুক্তি চেয়েছেন। স্বাধীনতার পর ৭৩ এ জাপানে গিয়েছিলেন এবং জাপান সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন যমুনায় সেতু নির্মাণের জন্য। জাপান সরকার ফিজিবিলিটি টেস্ট করে সেই সেতু করে দেন। শেখ হাসিনা বলেন, ৯৭ সালে তিনি জাপানে গিয়ে জাপানী প্রধানমন্ত্রীকে রূপসা ও পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় না আসতে পারায় এই সেতুর কাজ পিছিয়ে যায়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পদ্মা সেতুর কাজ আবারো শুরু করেন। সরকার গঠনের মাত্র ২২ দিনের মধ্যে জাপানের সমীক্ষার ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া হয়।
গ্রামীণ ব্যাংকের ডক্টর ইউনুসের প্রতি দিক নির্দেশ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি ভূমিকা রেখেছেন। অনেকেই বিরোধীতা করেছেন। কিন্তু নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশবাসীর কাছ থেকে সাড়া পাওয়াতে এই সেতু করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি ধসে পড়েনি। করোন মহামারী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ মোকাবেলা করেও বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকে আছে। এজন্য বাংলাদেশের জনগনতে সেলুট জানান শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বিশ্বের সবথেকে খরস্রোতা নদী আমাজন, তারপরই পদ্মা। এই খরস্রোতা পদ্মার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে গুনগত মানের সাথে আপোস না করে সেতু নির্মাণ করা হয়। ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এই সেতুর পাইল বসানো হয়েছে যা বিশ্বরেকর্ড।
বক্তব্যের পর তিনি বাংলাদেশ ডাকবিভাগ কর্তৃক বিশেষ ডাকটিকেট ও স্যুভেনির উন্মোচন করেন। এরপর তিনি উন্মোচন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একশ টাকার বিশেষ নোট। চাইনিজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সেতুর রেপ্লিকা তুলে দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর এক পাশে ছিলেন খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, অন্যপাশে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আর তার পাশে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম ছিলেন।
স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিক, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন, ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেন নেতারা।
উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী টোল দিয়ে সেতু পেরিয়ে যান ওপারে, শরীয়তপুরের জাজিরায়।সেখানে যথারীতি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরে মাদারীপুরের বাংলাবাজারে অংশ নেন আওয়ামী লীগ আয়োজিত লাখো মানুষের জনসভায়। রোববার পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হবে চলাচলের জন্য।
৩০১৯৩ কোটি টাকা ব্যায়ে পদ্মার বুকে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুতে গাড়ি ও রেল দুটোই চলবে। নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর, শেষ হল সাত বছরে।