Home মতামত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পবিত্র রমজান

356

বোরহান উদ্দিন রব্বানী :

মা-বাবা পরিবার পরিজন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রমজান অনেকের। আবার অনেকে ৪/৫ বছর ধরে এভাবে চালিয়ে আসছেন এমন শিক্ষার্থীরও দেখা মিলবে। অনেক ডিপার্টমেন্ট/ ইনস্টিটিউটের ক্লাস বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন ছোঁয়ার তাগিদে পড়াশোনা করার জন্য রমজানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন। তার প্রমান পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে গেলে। অনেকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টা একটা পরিবার। মাথা গোঁজার ঠাঁই।

পবিত্র রমজান মাস আসলেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস ও হলগুলো এক উৎসবের আমেজে মেতে থাকে। যা ক্যাম্পাস আর হলেই সীমাবদ্ধ না! এছাড়া এ সময়ে বটতলা , ক্যাফেটরিয়া, সেন্ট্রাল ফিল্ড কিংবা ক্যাম্পাসের অন্যান্য স্থানে ইফতারের এক উৎসব বিরাজ করে।
সেহরিতে চলে শিক্ষার্থীদের দৌঁড়-ঝাপ। মেয়েদের হলগুলোতে সেটা না থাকলেও, ছেলেদের হল গুলোতে রয়েছে একধরনের প্রতিযোগিতা। এক হল থেকে অন্য হলে স্বল্প মূল্যে পছন্দের খাবার খেতে যাওয়াতে রয়েছে এক ধরনের অবাধ প্রতিযোগিতা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো দিনের বেলায় আলোতে যেমন, রাতেও ঠিক তেমনই। এমন আলোর মধ্যে থেকেও, নিজেদের আলোয় আলোকিত করতে মরিয়া এখানকার প্রত্যেকটা শিক্ষার্থী। প্রতিটা রাত, প্রতিটা দিন এখানে ‘স্বপ্ন পূরণের গল্প’ লিখা হয়। রাত-দিনের হিসেব, এখানে কেউ করে না। হিসেবে করে স্বপ্ন পূরণের দিন-ক্ষণ, হিসেবে করে কত দিন, কত রাত বাকি স্বপ্নের কাছে যেতে। রমজান এসে ‘স্বপ্ন’ আর সেই স্বপ্ন পূরণে মহান আল্লাহ তা’লার সন্তুষ্টি লাভের আশায় মশগুল থাকে এ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা।

তারাবির সালাত দিয়ে একটি রোযার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হলের মসজিদগুলোতে ভরে উঠে শিক্ষার্থী দিয়ে। জায়গা না মেলায়, কার্পেট বিছিয়ে হল মাঠে সালাত আদায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তারাবির নামায মাত্র শেষ হয়েছে। নামায শেষে কেউবা ক্লান্ত শরীরে হিম-শীতল বাতাস লাগাতে লাগাতে আপন মনে কার্পেটে শুয়ে রাতের আকাশ দেখেন আর বুকে স্বপ্ন লালন করেন।

তারাবির নামায শেষ করে, কেউ পড়তে চলে যায় রিডিং রুমে, কেউ বা বসে আড্ডায়। অনেকে আড্ডায় কেটে দিলেও। কেউ কেউ রিডিং রুম থেকে একবারে সেহেরি খেতে যাবে। অনেক শিক্ষার্থীর অভিযোগ রমজান আসলে খাবারের দাম বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। রমজানে সেহরি-ইফতার সব মিলিয়ে খেতে গেলে দৈনিক ২০০ টাকার মত পড়ে যায়। যেখানে রমজান ব্যতীত অন্য সময়ে তাঁর লাগে ৭০-৯০ টাকা। শিক্ষার্থীরা মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সচেতন থাকলে বাড়িত দাম নিতে পারবে না ব্যবসায়ীরা।

ইফতারিতে জাবি যেন এক টুকরো উৎসবের কেন্দ্রে পরিণত হয়: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে ইফতারের আমেজ লাগে সেই দুপুর ৩ টা থেকে। ক্যাম্পাসের সাবেক, বর্তমান কিংবা বহিরাগতরা মেতে ওঠে ইফতারির আমেজে। সিডনি ফিল্ড , টিএসসি,বটতলা, সেন্ট্রাল ফিল্ড, ক্যাফেটেরিয়া, হলগুলোর সম্মুখে ইফতার নিয়ে ব্যস্ত থাকে সবাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটোরিয়াম ও সেমিনার কক্ষে প্রত্যেক কোন কোন সামাজিক/স্বেচ্ছাসেবী/ রাজনৈতিক/সাংস্কৃতিক /সাহিত্যিক / জেলা সমিতির ইফতার অনুষ্ঠান দেখা যায়।
ঠান্ডা শরবত, ফল, ছোলা-বুট, বুন্দিয়া, বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ হাজারো রকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানিরা। বন্ধু-বান্ধব, সিনিয়র – জুনিয়র কিংবা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে বসে ইফতারি খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া রমজান মাসে যেন এখানকার নিত্য-নৈমেত্তিক ব্যাপার। টিএসসি, বটতলা, সেন্ট্রাল ফিল্ড, ক্যাফেটেরিয়া, পুরাতন কলা, মহুয়া মঞ্চে
ইফতারির আয়োজনে মেতে ওঠার দৃশ্য যেন চোখে পড়ার মত। সবচেয়ে বেশি দেখার মতো জায়গা তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল ফিল্ড। সেখানে গোলাকার হয়ে বসে থাকতে দেখা যায় শত শত রোজাদার শিক্ষার্থীদেরকে। পাশে কয়েকজন মিলে তৈরি করছে বাহারি আইটেমের ইফতারি। দৃশ্যটি একেবারে ছবির মতো। যেন পরিবারের সদস্যরা একসাথে বসে আছে ইফতারের অপেক্ষায়। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরাও মিশে গেছেন রোজাদারদের সাথে। তারাও ইফতারের অপেক্ষায় বসে থাকে বন্ধুদের সাথে কিংবা সিনিয়র জুনিয়রদের সাথে।

গোল হয়ে পত্রিকা কিংবা বড় গামলা বিছিয়ে ইফতারির আয়োজনে মেতে ওঠেন সিনিয়র জুনিয়র বর্তমান, সাবেক, বহিরাগতদের কোন গ্রুপ কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। পারস্পরিক ফেলে আসা হৃদ্যতার সম্পর্কের স্মৃতিচারণ একজন আরেকজনের খোজ খবর নেওয়া, কিংবা বড় ভাইদের উপদেশ ইফতারির এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে চলে। হলগুলোর মাঠেও চলে নানান আয়োজনে ইফতার। মসজিদে যখন মুয়াজ্জিন মধুর সুরে ডাক দেন হে মুমিন রোজাদারগণ ইফতারের সময় হয়েছে। তখন সবাই একসাথে খাওয়া শুরু করে।
এতো সুন্দর, এতো বৈচিত্র্য ও ভালোবাসা বন্ধন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব।

-লেখক: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ।