।। মুক্তার হোসেন নাহিদ।।

১৯২১-এ বাগান বাগান ছেড়েছিলেন ‘মল্লুকে চলো’ আন্দোলনে। এবার ছেড়েছিলেন ‘মজুরি বৃদ্ধি’র লড়াইয়ে। ১০০ বছর আগে চাঁদপুরের সেই রক্তগঙ্গা লড়াইয়ে বহুপ্রাণ হারিয়ে বাধ্য হয়েছিলেন বাগানে ফিরতে। এবার ফিরলেন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে। ফিরতেই হবে। এটাই হতভাগা চা শ্রমিকের জীবন। অথচ বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ আর উত্তর প্রদেশ থেকে ব্রিটিশ ভারতের এই বাংলায় এসেছিলেন উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়। পাতা নড়বে, টাকা পড়বে-ভালো থাকবেন, ভালো খাবেন এমন লোভে তারা পা দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের ঘেরাটোপে। সেই যে দাসত্বের জীবনে পা-১৮২ বছরেও তা থেকে মুক্তি মিলেনি। মুক্তির সম্ভাবনাও ক্ষীণ। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও দাসত্বের নিগড় থেকে রক্ষা পাননি চা শ্রমিকরা। তাদের ঘাড়ে আজো চেপে বসে আছে নব্য দাসপ্রথা। চা বাগানেই তাদের সূর্য উঠে, সেখানেই সূর্য ডুবে। পাতা নাড়ে, পাতা খায়, পাতার ঘরে থেকে বাংলা মদে জীবনের কষ্ট ভুলেন।

টানা ১৯ দিনের লড়াই। দাবি দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা দিতে হবে। মালিকপক্ষ দিয়েছিল ২৫ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে চা শ্রমিকরা পেলেন ৫০ টাকা। এখন দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা। আকাশছোঁয়া নিত্যপণ্যের দামের এই দুঃসময়ে যদিও ১৭০ টাকা নিতান্তই কম, তারপরেও শ্রমিকরা বাগানে ফিরেন মহাখুশিতে। চা বাগানের শ্রমিক পল্লীতে খুশির জোয়ার। কেবল মজুরি’ই বৃদ্ধি করেননি, প্রধানমন্ত্রী তাদের সাথে কথা বলেছেন, কষ্টের কথা শুনেছেন, দাবি পূরণের আশ^াস দিয়েছেন-এতেই আনন্দে আত্মহারা। অল্পতেই কত খুশি! খুশি না হয়েই বা উপায় কি! এক খÐ নিজস্ব ভূমি নেই, চা বাগানের বাইরে মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, বাগানের বাইরে বিশাল জগতেও মেশার উপায় নেই। এর থেকে আর কিইবা আশা করতে পারে!

১৮৪০-উপমহাদেশের চা বাগানের যাত্রা শুরু। বাণিজ্যিক যাত্রা ১৮৫৭ তে। সে সময় ইংরেজরা চা শ্রমিকদের পূর্বপূরুষদের উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে ধরে আনে। দরিদ্র মানুষগুলোও সেদিন বিশ্বাস করেছিলেন, নিজস্ব মুলুক ছেড়ে আসলেই তারা ‘গাছ নাড়বে টাকা পাবে’, জীবন পাল্টাতে পারবে। কিন্তু  না, জীবন পাল্টায় নি। বরং বাঙালি বাবু আর ইংরেজ সাহেবরা ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছিলেন। সেই দাসত্ব থেকে এখনো মুক্তি মিলছে না। উল্টো আধুনিক সভ্যতার নতুন সংস্করণ ‘নব্য দাসত্বে’র বেরাজালে বন্দী হয়ে আছেন হতভাগা শ্রমিকরা। ক্লান্ত জীবনে সতেজতার প্রত্যায়শায় এ সমাজের মানুষ যে চা খান, সেই চা পাতার সাথে মিশে আছে লাখো শ্রমিকের রক্ত, ঘাম আর কষ্টগাঁথা। সে কথা আমরা ক’জনই বা জানি। মজুরিবৃদ্ধির আন্দোলনে সেই চিত্রই ভেসে উঠেছে দেশবাসীর সামনে। তাই তো এবার চা শ্রমিকদের দাবি সাথে একত্মতা ঘোষণায় লড়াইয়ে নেমেছিলেন বহু বিবেকবান মানুষ। হু হু করে পণ্যমূল্য আর জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধির চাকায় পিষ্ট চা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে হবে-আওয়াজ উঠেছিল দেশজুড়ে। কিন্তু মালিকরা বললেন, ১৪৫ টাকার বেশি মজুরি দেয়া যাবে না। কারণ তাদের নাকি আরো অনেক সুবিধা দেওয়া হয়।

চা বাগান মালিক পক্ষের দেওয়া সুবিধার গোঁজামিলের হিসাব এবং প্রহসন স্পষ্ট হয়ে উঠে গণমাধ্যমে। তারা শ্রমিকদের মাত্র ১২০ টাকা মজুরি দিতেন, তাও শর্ত সাপেক্ষে। তার সাথে গড়ে ৪৬ টাকা রেশন, ৭ টাকা ঘরভাড়া এবং অন্যান্য সুবিধা মিলে শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি পেতেন ১৮৫ টাকা। ২৩ কেজি পাতা তুলতে না পারলে প্রতি কেজিতে মজুরি থেকে কেটে নেওয়া হতো প্রায় ৬ টাকা। আর ২৩ কেজির বেশি পাতা তুললে দেওয়া হতো কেজিতে ২ টাকা। পাতা মাপায় রয়েছে নানা কারসাজি। টাকা কেটে নেওয়া হতো বিভিন্ন অজুহাতে। ফলে শ্রমিকরা কখনোই নগদ ১২০ টাকা হাতে পেতেন না।

মালিক পক্ষ বলেছেন, দৈনিক মজুরির বাইরে শ্রমিকদের বাসসস্থান, বিদ্যুৎ, পানি, স্যানিটেশন, রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বোনাস সুবিধা দেওয়া হয়। অথচ শ্রম আইন অনুযায়ী এসব সুবিধার কোনোটিতেই মালিকের দেয়া টাকা মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না, কারণ গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে মালিকরা বাধ্য। নারী শ্রমিকরা আবার পোষ্যের জন্য রেশন পান না; বৈষম্যের শিকার হন।

রেশনের ক্ষেত্রেও হিসাবের ভিন্নতা রয়েছে। পরিবারের স্বামী কাজ করলে সপ্তাহে ৩ কেজি ২০০ গ্রাম আটা বা চাল পাবে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী পাবে ২ কেজি ৮০০ গ্রাম, ১২ বছরের নিচে দুজন শিশু ২ কেজি ৪০০ গ্রাম করে রেশন পাবে। কিন্তু স্ত্রীর নামে কাজ থাকলে স্বামীর রেশন নেই। আর ১২ বছরের উপরে শিশুদের জন্য কোনো রেশনই নেই। নানামুখী বৈষম্যের চোরাবালিতে আটকা মালিকপক্ষের হিসাব। যদি পরিবারে শুধু স্ত্রী বাগানে কাজ করে এবং সন্তান না থাকে, তাহলে তার প্রাপ্য রেশনের পরিমাণ পরিমাণ মাত্র ৩ কেজি ২০০ গ্রাম। সব মিলিয়ে হিসাব করে বলা যায় সপ্তাহে রেশন পান ৬ কেজি থেকে ৯.৩৭ কেজি আর মাসে সর্বমোট রেশন পান ২৪ কেজি থেকে ৩৭.৪৮ কেজি। কেজি প্রতি দাম শ্রমিকদের কাছ থেকে নেয়া হয় ২ টাকা। কেজি প্রতি ৪৫ টাকা ভর্তুকি দিলে মাসে রেশন বাবদ শ্রমিকরা পান ১০৮০ টাকা থেকে সরবোচ্চ ১৬৮৬ টাকা। তাহলে দিনে দাঁড়ায় ৩৬ টাকা থেকে ৫৬ টাকা। কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। এই রেশনকে দৈনিক মজুরির অতিরিক্ত ভাতা বলা যায়। যদিও পুলিশ, বিজেপি, আর্মি সহ অন্যান্য পেশায় রেশনকে মজুরি হিসেবে দেখানো হয় না।

চা শ্রমিকদের কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। চা-বাগানে নারী শ্রমিকদের শৌচাগার নেই। এ জন্য চা-বাগানের ভেতরেই শৌচকর্ম সারতে হয়। চা-বাগানের নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি কম পান, গর্ভবতী নারীরা পেটে সন্তান নিয়েও কাজ করেন। আর তাদের ফ্রি চিকিৎসার নামে যা দেওয়া হয়, দুবেলা প্যারাসিটামল। পানীয় জলের সন্ধানে এরা মাথায় কলসী নিয়ে যায় দূরের ছড়ায়। ইদানিং কিছু কোম্পানি কিংবা এনজিও এদের গভীর নলকূপ দিচ্ছে, স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করছে। এজন্যও ১২০ টাকা থেকে নির্দিষ্ট হারে কিস্তি পরিশোধ করতে হয় এদের। ফলে সপ্তাহ শেষে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর শ্রমিকদের হাত হয় শূন্য।

ঘর বলতে কোম্পানি প্রদত্ত মাটির দেয়াল আর ছনের ছাউনি দেওয়া একটা ছোট্ট ঘর। বছর পাঁচ বছরেও সংস্কার হয় না সেসব ঘরের। বৃষ্টিতে পানি পড়ে আর শীতে হু হু করে কুয়াশা। শ্রমিকদের ঘর তৈরি করতে যে খরচ তাতে দৈনিক ঘর ভাড়া আসে গড়ে ৭ টাকা। সেখানে মালিকরা ঘরভাড়া বাবদ ধরেছে প্রায় ৭৭ টাকা। এরপরও তারা বিনামুল্যে বাড়ি দেয়ার কৃতিত্ব দাবি করছেন। এই ঘর পায় কেবল নিবন্ধিত শ্রমিক। এই নিবন্ধিত শ্রমিকদের প্রায় ৬৪ ভাগই নারী। এক নারী কোনো কারণে অক্ষম হলে পরিবারের অন্য নারীকে স্থলাভিষিক্ত করতে হয়। নইলে তার বসবাসের ভূমিটি হারায়। হারায় নড়বড়ে ঘরটি। ফলে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ধরে রাখার জন্য নিবন্ধিত হতেই হবে। নব্য দাসদের এ এক অনিবার্য অসহায়ত্ব।

চা হয় না এমন নিচু কিছু জমি চাষবাস করার জন্য শ্রমিকদের দেয়া হয়। এ জন্য মজুরিতে তা হিসাব করে দেখানো হয়েছে। যারা বাগানের জমি আবাদ করেন তাদের রেশন কেটে রাখা হয়। আবার ধান খেতের জন্য ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হয় মাসে তিন টাকা। সংসারের অভাব মেটানোর জন্য পতিত জমিতে আবাদ করে তাকে উন্নত করেছে শ্রমিকরা এটাকেও মজুরির অংশ বানানোর কথা বলা হয়েছে। বাসাবাড়িতে এক চিলতে জমিতে একটা লাউ, পেপে কিংবা পেয়ারা গাছের ফলের দামও হিসেবের বাইরে নেই! গুণতে হয় ১৪ টাকা!

বলা হচ্ছে চা শ্রমিক সন্তানদের সুশিক্ষা নিশ্চিতকরণে অনেক সুবিধা দেওয়া হয়। তার জন্য প্রাথমিক, জুনিয়র ও উচ্চ বিদ্যালয়সহ সর্বমোট ৭৬৮ টি বিদ্যালয় রয়েছে। যেখানে শিক্ষক আছেন  ১ হাজার ২৩২ জন। শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৪ হাজার ১৭১ জন।  ১৬৮টি বাগানে ৭৬৮ টি বিদ্যালয় হলে গড়ে প্রতি বাগানে সাড়ে ৪ টি বিদ্যালয়। কিন্তু একটা হিসাব সব গোলমাল করে দিল। শিক্ষক আছে নাকি ১২৩২ জন। মানে বাগান প্রতি বস্ত দেড়জন শিক্ষক। এই হিসাব মেলাতে পারছি না-প্রতি বাগানে বিদ্যালয় ৪ জন, আর শিক্ষক দেড়জন। তাহলে বাকি বিদ্যালয়ের শিক্ষক কোথায়?

অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন-এত বঞ্চনা, তবুও চা শ্রমিকরা বাগানেই পড়ে আছেন কেন? চা শ্রমিকদের অসহায়ত্ব এখানেই। তারা চাইলেই পেশা বদল করতে পারেন না। চা বাগানের গÐি পেরোনোর ক্ষমতাও তাদের নেই। কারণ বাগান থেকে বের হয়ে ঢাকায় এসে এক মাস জব কাজ খুঁজে কাজ করা, থাকা-খাওয়ার মতো সেভিংসটাও তাদের থাকে না। আবার ঢাকায় পথ দেখানো, এক মাস নিজের ঘরে রাখা, গারমেন্টসের এইচআর-এর দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া-এমন লোকও তাদের নেই। তাই বাগান ছেড়ে বের হওয়ার সাহস তারা পান না।

অন্যদিকে বাঙালিরা চা শ্রমিকদের সামাজিকভাবে নিচু জাত হিসেবে ট্রিট করে। চা শ্রমিকেরা মদ খান, শুকর পালে, শুকর খান এবং এমন কি তাদের গাত্র বর্ণ অধিক গাঢ়। এখনো আধুনিক এই উন্নত সভ্যতায়ও চা শ্রমিকরা বর্ণবাদী বেড়াজালেই বন্দী। ফলে ঢাকায় এসে বস্তিতে থাকতে পারা, চাকুরি খুজে পাওয়া, সেইখানে জীবন-যাপন করতে পারার বিশ্বাস তাদের নেই। অনেকে চেষ্টাও করেছে, কিন্তু ঋণে জর্জড়িত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে।

চা শ্রমিকদের বাইরের আসার এই অক্ষমতা তাদের অযোগ্যতা নয়। মূলত চেতনায় দাসত্ব। আগেই বলেছি, তারা পাতা তুলে, পাতা খায়, পাতার ঘরে থেকে বাংলা মদের নেশায় ডুবে থাকে। ডুবে থাকতে বাধ্য করা হয়। প্রতিবাদ করতে পারে না। জন্ম থেকে মৃত্যু-চা শ্রমিকদের জীবনসূর্য চা বাগানেই আটকা থাকছে, আটকে রাখা হচ্ছে। অথচ তারাও এদেশের নাগরিক। নাগরিক সুবিধা পাওয়া অধিকার তাদেরও আছে। রাষ্ট্র সকলের। রাষ্ট্র সকল জনগোষ্ঠীর। তারপরেও কেন চা শ্রমিকদের দাসত্বের জীবন-এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

লেখকঃ সাবেক ছাত্রনেতা