Home মতামত কিউবাকে পাল্টে দিয়েছিলেন ইতিহাসের বিপ্লবী মহানায়ক কমরেড ফিদেল ক্যাস্ট্রো

কিউবাকে পাল্টে দিয়েছিলেন ইতিহাসের বিপ্লবী মহানায়ক কমরেড ফিদেল ক্যাস্ট্রো

46

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

কিউবাকে পাল্টে দিয়েছিলেন ইতিহাসের বিপ্লবী মহানায়ক কমরেড ফিদেল ক্যাস্ট্রো। আর তাই বন্ধু ফিদেলকে নিয়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছিলেন, ‘তার সামরিক-বেসামরিক নাম, পদবি আছে কয়েকটি। কিন্তু সবগুলোর মধ্যে সাধারণ মানুষের কাছে টিকে আছে তার একটাই নাম: ফিদেল। সাধারণ মানুষেরা তাকে ঘিরে ধরে। …তার সাথে তারা তর্কাতর্কি করে, ভিন্নমত পোষণ করে, তার কাছে দাবি জানায়।…যার জীবন অনাড়ম্বর, ভাবনায় যে অতৃপ্ত…, যে কথায় সতর্ক, ব্যবহারে সরল, অসাধারণ নয়- এমন কোনো ভাবনা ভাবতে যে অক্ষম, তিনি এমনই একজন মানুষ; সেই মানুষটি স্বপ্ন দেখেন, তার বিজ্ঞানীরা ক্যান্সার নিরাময়ের পথ খুঁজে পাবেন, সেই মানুষটি বিশ্ব পরিধিতে প্রভাব ফেলার মতো পররাষ্ট্র নীতি দাঁড় করিয়েছেন এমন এক দ্বীপে, যে দ্বীপে সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য, যে দ্বীপটি তার প্রধান শত্রুর চেয়ে ৮৪ গুণ ছোট। তার প্রগাঢ় প্রত্যয় যে, বিবেকের যথাযথ গঠনই মানুষের মহোত্তম সাফল্য, আর বৈষয়িক তাড়না নয়, নৈতিক উদ্দীপনাই পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে, পারে ইতিহাসকে এগিয়ে নিতে। তার এ প্রত্যয় এতই গভীর যে তা প্রায় অতীন্দ্রিয় বিশ্বাসতুল্য। আমাদের সময়ের মহত্তম আদর্শবাদীদের একজন তিনি।’
২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর কমান্দান্তে ফিদেলের দেহাবসান হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সহযোগীরা ৬৩৮ বার তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে বলে জানা যায়। প্রতিবারই তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। ৯০ বছরের দীর্ঘ পথ মাথা উঁচু করে পাড়ি দিয়ে ফিদেলের দেহে আজ প্রাণ নেই। তবু সারা বিশ্বের জনগণের কাছে তিনি এখনো প্রবলভাবে আছেন, আছেন বিপ্লবের আইকন হয়ে, সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক হয়ে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে। কিউবা বিপ্লবের বহু বছর পরেও রাইফেল কাঁধে, হাভানা চুরুট হাতে বেরেটো পরিহিত শ্মশ্রুমণ্ডিত ফিদেলের ছবি আমাদের চোখে ভাসে, লড়াই করার প্রেরণা জোগায়। ফিদেলকে নিয়ে অসংখ্য গান, কবিতা রচনা হয়েছে, সিনেমা বানানো হয়েছে, অসত্য প্রোপাগাণ্ডাও হয়েছে। সবকিছু ছাপিয়ে ৯০ বছর বয়সেও ফিদেল যেন ছিলেন দুর্বার তারুণ্যের প্রতীক।
ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বাবা ছিলেন স্পেনের অধিবাসী, মা কানারিয়ান কিউবান। ফিদেলের বাবাকে কিউবার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে স্পেনের হয়ে যুদ্ধ করতে কিউবাতে পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র তখন ইন্দোনেশিয়া, পুয়ের্তেরিকোসহ স্পেনের উপনিবেশগুলো দখল করতে শুরু করেছে, কিন্তু স্বাধীনতাকামী কিউবাকে সরাসরি দখল করতে পারেনি। তবে নিরুপায় ও কোনঠাসা স্পেন ১৮৯৮ সালে প্যারিসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করে এবং কিউবার সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়। যুদ্ধ শেষে ফিদেলের বাবা স্পেনে ফিরে যান, তবে কিউবা তার ভালো লেগে যাওয়ায় সাত বছর পর আবার ফিরে আসেন। কিউবায় তিনি ওরিয়েন্ত প্রভিন্সের উত্তরের বিরান নামে এক গ্রামে আমেরিকান ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির মজুর হিসেবে কাজ শুরু করেন। আখ চাষ করে ফিদেলের বাবা’র লাভ হতে থাকে এবং তিনি অবস্থাপন্ন হয়ে ওঠেন, সেখানেই জমিজমা কেনেন। ফিদেলের জন্মও সেই গ্রামেই, ১৯২৬ সালের ১৩ আগস্ট। কালের পরিক্রমায় বহু বছর পর সেই ফিদেল যখন বলেন, ‘আমার নাম ফিদেল ক্যাস্ট্রো, কিউবাকে মুক্ত করার জন্যই আমার জন্ম হয়েছে’- তখন তা একদমই অত্যুক্তি মনে হয় না।
ফিদেল রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন ছোটবেলাতেই। অবস্থাপন্ন ভূস্বামী হওয়ায়, নির্বাচনের সময় তার বাবা বেশ কিছু ভোট নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেকারণেই নির্বাচনের হাওয়া লাগতো তার বাড়িতে। ১৪ বছর বয়সে ফিদেলের এক ভাই ওরিয়েন্ত প্রদেশে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ফিদেল তখন গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি শেখাতেন। হয়তো অবচেতনেই, মানুষের সাথে যোগাযোগের ভাষাটি রপ্ত হয়েছিলো সেসময়েই। ফিদেলের বয়ানে, ‘উঠতি ভূস্বামীর ছেলে হিসেবে আমার অন্তত গ্রামে থাকার সুযোগ হয়েছিলো। চাষিদের সাথে, গরিবদের সাথে আমি মেলামেশা করতে পারতাম। তারা সবাই ছিলো আমার বন্ধু।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ফিদেল জড়িয়ে পড়েন ছাত্র আন্দোলনে। ল’স্কুলে প্রথম বর্ষেই তিনি প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড়ান ও নির্বাচনে জেতেন। তিনি যেকোনো অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাও সেসময় তার ভেতরে দানা বাঁধতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তিনি ডোমিনিকান গণতন্ত্র সমর্থন কমিটি ও পুুয়ের্তে রিকোর মুক্তি কমিটির সভাপতি হয়ে যান। এক পর্যায়ে ১৯৪৭ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকে তখনকার স্বৈরশাসক রাফায়েল ত্রুজিলোকে উৎখাতে এক বিদ্রোহে অংশ নেন ফিদেল। পরের বছর চলে যান কলম্বিয়ার বোগোতায় লাতিন আমেরিকার ছাত্রদের সংগঠিত করে একটি ছাত্র কংগ্রেস আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়ে, পরে জড়িয়ে পড়েন সরকারবিরোধী বিক্ষোভে। একপর্যায়ে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। লাতিন আমেরিকান বিপ্লবীরা কখনোই বোধহয় নিজ দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে চাননি।
ফিদেল নিজেই স্বীকার করেছেন, প্রথম দিকে তিনি ছিলেন কল্পনা আশ্রয়ী কমিউনিস্ট। স্কুলের ন্যায় নীতি সংক্রান্ত আদর্শবাদী ধারণাগুলো তাকে সমাজ বিশ্লেষণের দিকে নিয়ে যায়। এর পর তিনি হোসে মার্তির দ্বারা প্রভাবিত হন, যে প্রভাব তার আজীবন ছিলো। তার মতে, ‘মার্তির লেখায় এমন সব মহান ও সুন্দর বিষয় আছে যে, তার চিন্তাধারাকে আরম্ভ হিসেবে ধরলে আপনি এক পর্যায়ে মার্কসবাদী হয়ে যাবেন।’একসময় তার হাতে আসে কমিউনিস্ট ইশতেহার। ক্যাস্ট্রো বলছেন, ‘একদিন আমার হাতে এলো কমিউনিস্ট ইশতেহারের একটি কপি। আমার কাছে মনে হলো আমার জ্ঞান চোখ খুলে দেওয়া হচ্ছে…মানব সমাজ যে বিবর্তনের ফসল, এ যে ইতিহাসের নিয়মের ফসল, তা যে অপরিবর্তনীয় আইন নয়, দ্বান্দ্বিক নিয়মের ফসল, সে কথা আগে জানতামই না, ভাবতেই পারতাম না।’
‘কমিউনিস্ট’হয়ে ওঠার পথে থাকা ক্যাস্ট্রো কিন্তু প্রথমে কোনো বামপন্থি পার্টিতে যোগ দেননি। তিনি প্রথমে যোগ দিয়েছিলেন কিউবান পিপলস পার্টিতে, যা মূলত ছিলো সংস্কারপন্থি, এমনকী মার্কিনপন্থিও বটে। ফিদেল ছিলেন সেই পার্টির বাম অংশের নেতা। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দেয়ার কারণ হয়তো ফুটে ওঠে ফিদেলের এই বয়ানে, ‘সাম্রাজ্যবাদ, ম্যাককার্থিবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির সর্বগ্রাসী পরিবেশের কারণে কিউবার কমিউনিস্টরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে তারা শক্তিশালী ছিলেন, পার্টির অনেক সদস্য শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে কাজ করতেন, শ্রমিকদের মাঝে তারা তুমুল জনপ্রিয়ও ছিলেন, কিন্তু সে পরিস্থিতিতে তাদের কোনো রাজনৈতিক সম্ভাবনা চোখে পড়ে নি।’ তবে ফিদেলের নেতৃত্বে সংগঠিত কিউবান বিপ্লবে ‘পপুলার সোশ্যালিস্ট পার্টি’নামে পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টি শহরাঞ্চলে একের পর এক ধর্মঘট করে, আন্দোলন সংগঠিত করে বিপ্লবে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিলো। বিপ্লবের পর পপুলার সোস্যালিস্ট পার্টি, ফিদেলের ২৬ জুলাই মুভমেন্ট দল, ছাত্রদের রেভ্যুলেশনারি ডিরেক্টরি গ্রুপ একীভূত হয়ে কিউবান কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে।
১৯৫২ সালে জেনারেল বাতিস্তা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পরবর্তী নির্বাচন বাতিল ঘোষণা করলে ক্যাস্ট্রো ও তার দলের কয়েক সদস্য মার্কিন মদদপুষ্ট স্বৈরশাসনের অবসান ঘটাতে অভ্যূত্থানের পরিকল্পনা করেন। এজন্য তারা ‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেন। ১৯৫৩-র ২৬ জুলাই দ্য মুভমেন্টের ১৫০ সদস্য কিউবার সান্তিয়াগোর মানকাদা মিলিটারি ব্যারাকে আক্রমণ করে। এই দলটিই পরবর্তীতে ২৬ জুলাই মুভমেন্ট দল হিসেবে পরিচিতি পায়। ওই অভ্যূত্থান ব্যর্থ হলে বাতিস্তা সরকার ক্যাস্ট্রোকে বন্দি করে। এরপর এক প্রহসনের বিচারে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বিচারকালে ফিদেলের ভাষণ তাকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন- ‘আমাকে অপরাধী বানাতে পার, কিন্তু ইতিহাস আমাকে দায়মুক্তি দেবে।’দুই বছর পর গণআন্দোলনের মুখে এক চুক্তিতে মুক্তি পেয়ে সহযোগীদের নিয়ে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান ফিদেল।
মেক্সিকোতে ফিদেলের পরিচয় ঘটে আরেক কিংবদন্তি বিপ্লবী চে গেভারার সাথে। এক আড্ডায় চে ক্যাস্ট্রোর সাথে পরিচিত হন, এবং জুটে যান কিউবান বিপ্লবীদের সাথে। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ব্যক্তিত্ব চে’কে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। চে’র ভাষায়, ‘.. স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কোনো বিপ্লবে যোগ দেয়ার জন্য আমাকে খুব বেশি বোঝানোর কিছু ছিলো না। তবে অসাধারণ মানুষ হিসেবে ফিদেল আমাকে মুগ্ধ করে। সে অসম্ভব সব বিষয় সম্ভব করতো, সামাল দিতো। তার অতুলনীয় প্রত্যয় ছিলো যে, কিউবার উদ্দেশ্যে একবার রওনা দিলে সে কিউবা পৌঁছাবেই, পৌঁছালে সে লড়াই শুরু করবেই এবং লড়াই করে সে জয়লাভ করবেই। আমি ছিলাম তার আশাবাদের শরিক।’
ফিদেল, রাউল ও চে কিউবায় পুনরায় ফিরে গিয়ে বাতিস্তা সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেন। ১৯৫৬-র ২ ডিসেম্বর ফিদেল আর তার ৮২ জন সহযোগী অস্ত্রশস্ত্রসহ ছোট্ট নৌকা ‘গ্রানামা’য় চেপে কিউবার উত্তরাঞ্চলের মানজানিলোতে নামার পরিকল্পনা করেন। তাদের আসার খবর পেয়ে বাতিস্তা সেখানে বাহিনী পাঠান। ফিদেলরা নামার সময় গুলি চালানো হলে বেশ কয়েকজন নিহত হন। চে আর রাউলসহ বাকিদের নিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রোর পার্বত্য জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন ফিদেল, সেখানে ঘাঁটি গাড়েন। জনগণের সমর্থনে ১৯৫৮-র শেষ দিক থেকে ফিদেল বাহিনী একের পর এক শহর দখল করতে থাকে। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ১৯৫৯-র জানুয়ারিতে কিউবা দখলে নেয় ‘টুয়েন্টি সিক্সথ অব জুলাই মুভমেন্ট’;বাতিস্তা পালিয়ে আশ্রয় নেন ডমিনিকান রিপাবলিকে। ফিদেল বহুদিন পর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিপ্লব শুরু করার সময় আমরা ছিলাম ৮২ জন। যদি আবার কখনো বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি করতে হয়, তবে এখন ১৫ জন, এমনকি ১০ জন হলেও চলবে। ১০ জন মানুষ এবং সত্যিকার বিশ্বাস সেটা থাকলে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। দরকার বিশ্বাস ও দরকার নিখুঁত পরিকল্পনা।’
শুধু সফল বিপ্লব করেই ফিদেল থেমে থাকেননি। জনগণকে সাথে নিয়ে বিপ্লবকে অগ্রসর করে নিয়ে গেছেন শত প্রতিকূলতার মুখেও। মার্কিনিরা কিউবার বিপ্লবকে ধ্বংস করতে একের পর এক চক্রান্ত করেছে, ফিদেলকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছে, ফিদেল দমেননি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই কারখানা এবং খামারগুলোকে জাতীয়করণ করেন তিনি, করেন ভূমি সংস্কার। এর পর কিউবায় ‘ফার্স্ট এগ্রেরিয়ান রিফর্ম অ্যাক্ট’-এর অধীনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং একইসঙ্গে কিউবায় বিদেশি কোম্পানির সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় আর যুক্তরাষ্ট্র চাপিয়ে দেয় বর্বর নিষেধাজ্ঞা। ১৯৬১ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো কিউবাকে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ঘোষণা করেন। এর জবাবে ওই বছরই সিআইয়ের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সাহায্যে কিউবা থেকে পালিয়ে যাওয়া ১৪শ’দেশত্যাগী ও মার্কিন সেনারা কিউবার ‘বে অফ পিগে’ফিরে ফিদেলকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। ফিদেলের নেতৃত্বে সে আক্রমণ রুখে দেয় কিউবার জনগণ।
লাগাতার অবরোধের মুখেও শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে কিউবা। বিপ্লবের পর কিউবা জুড়ে ১০ হাজার নতুন স্কুল খোলা হয়; শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়া হয় পাহাড়ি, দুর্গম প্রত্যন্ত সব অঞ্চলে। শিক্ষার হার রাতারাতি বাড়তে শুরু করে, বর্তমানে কিউবার সকলেই স্বাক্ষরতাজ্ঞানসম্পন্ন। ক্যাস্ট্রোর হাত ধরে কিউবা গড়ে তোলে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা; কিউবানরা এখন এমন এক সমাজব্যবস্থায় বসবাস করছেন যেখানে গড় আয়ু ৮০, শিশুমৃত্যুর হার হাজারে মাত্র ১১ জন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে সরকার উচ্চহারে ভর্তুকি দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, অনেকেই ভেবেছিলেন কিউবার পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বহু দেশে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে, বাংলাদেশসহ বহু দেশে কমিউনিস্টরা আদর্শকে পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু সবচেয়ে হুমকির মুখে থেকেও ফিদেল সে সময়েও বলেছেন, ‘সমাজতন্ত্র অথবা মৃত্যু।’ বিশ্বব্যাপী অবরোধের মুখে, জ্বালানির অভাবে কিউবানরা অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছে, কিন্তু ফিদেলের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি।
আন্তর্জাতিকতাবাদে দীক্ষিত ফিদেল ক্যাস্ট্রো এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে বিভিন্ন সময়ে গড়ে তোলেন ‘লাতিন আমেরিকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’সহ নানান সহায়ক প্রতিষ্ঠান। ’৭০ এর দশকে ক্যাস্ট্রো অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া ও ইয়েমেনসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিপ্লবের সমর্থনে সামরিক সহায়তাও পাঠান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম সমর্থন প্রদান করেন ফিদেল। কিউবা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী প্রথম কয়েকটি দেশের একটি। একবিংশ শতাব্দীতেও ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়াসহ লাতিন আমেরিকার যে দেশেই বামপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানেই ফিদেল সমর্থন জুগিয়েছেন। শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, গোটা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের অভিভাবক হিসেবে ফিদেল জায়গা করে নিয়েছেন, হয়ে উঠেছেন বিশ্বনেতা। শত্রু শিবিরও এখন তাকে সেই স্বীকৃতি না দিয়ে পারছে না।
ফিদেল রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পরও অবসর জীবন কাটাননি। যখনই পেরেছেন, জনসম্মুখে বক্তৃতা দিয়েছেন। কিউবান কমিউনিস্ট পার্টি ও লাতিন আমেরিকার বামপন্থি দলগুলোকে পরামর্শ দিয়েছেন। বিশ্বনেতারা যখনই কিউবা গেছেন, দেখা করেছেন ফিদেলের সাথে। বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে খবরাখবর রাখতেন তিনি আর তীক্ষ্ণ ভাষায় শাণাতেন শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ। ফিদেলের ভাষায়, ‘আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমার আসল নিয়তি হচ্ছে যুদ্ধ করা, যেটা আমি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চালিয়ে যাচ্ছি।’
২০১৬ সালের এপ্রিলে ফিদেল শেষবারের মত জনসম্মুখে এসেছিলেন, আদর্শে অটল থেকে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে তিনি বলেছিলেন, ‘হতে পারে এই কক্ষে আমার শেষ বক্তব্য এটি, তবে কিউবান কমিউনিস্টদের আদর্শ টিকে থাকবে এই প্রমাণ হিসেবে যে, এই গ্রহে যদি কেউ নিষ্ঠা ও মর্যাদার সাথে কাজ করে থাকে তবে তারা মানুষের প্রয়োজনীয় সমস্ত বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক দ্রব্য উৎপাদন করতে সক্ষম।’ তিনি শেষ বক্তৃতাতেও নিউক্লিয়ার যুদ্ধ এবং পুঁজিবাদী আগ্রাসনে পরিবেশ ধ্বংস সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়ে গেছেন।
ফিদেল শুধুমাত্র বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েই তিনি আজকের ফিদেল হন নি, অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেই হয়ে উঠেছেন প্রিয় কমান্দান্তে ফিদেল। তিনি ল্যাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পেরেছিলেন, এবং সে অনুযায়ী মার্কসীয় লেনিনিয় পদ্ধতির সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কিউবায়। হোসে মার্তির চিন্তার সাথে মার্কসবাদের জীবন্ত সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, ‘আমি মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি এই বিশ্বাস নিয়ে থাকতে চাই।’ তিনি তা পেরেছিলেন। যিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে যেতেন ক্লান্তিহীনভাবে, আজ তার কণ্ঠস্বর আপাতদৃষ্টিতে স্তব্ধ মনে হলেও, শোষিত মেহনতি মানুষের ভিড়ে কান পাতলে ফিদেলের কণ্ঠস্বর শোনা যাবে নিশ্চয়ই। ফিদেল আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ‘বিপ্লব গোলাপের শয্যা নয়; বিপ্লব হচ্ছে মৃত্যু পর্যন্ত অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সংগ্রাম।’ ৯৬তম জন্মবার্ষিকীতে কমরেড ফিদেল ক্যাস্ট্রো লাল সালাম।

-লেখক:মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।