Home মতামত কিংবদন্তি সাংবাদিক তোয়াব খানের জীবনালেখ‍‍্য

কিংবদন্তি সাংবাদিক তোয়াব খানের জীবনালেখ‍‍্য

43

জাকির হোসেন আজাদী: শরতের শান্ত নদীর চরে যখন সাদা কাশফুল দোল খাচ্ছে অনাবিল আনন্দে, শেফালির শুভ্রতা ও মোহনীয় গন্ধে প্রকৃতি যখন আনন্দে আত্মহারা, যখন বিলের জলে পাখা মেলে লালপদ্ম, ঠিক সেই সময় শরতের শিউলি ফুলের মতো মিষ্টি ঘ্রাণ বিলিয়ে আমাদের মাঝ থেকে ঝরে গেলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের উজ্জল নক্ষত্র কিংবদন্তি সাংবাদিক তোয়াব খান।

বিদগ্ধ সাংবাদিক তোয়াব খান ছিলেন সম্পাদকদের সম্পাদক। যুগস্রষ্টা হিসেবে আজীবন শ্রদ্ধা-ভালবাসা পেয়েছেন। তাঁর বোধের গভীরে ছিল উদারনৈতিক চিন্তা ও প্রগতিবাদী দর্শন। সারাজীবন বাঙালিত্বের অহর্নিশ চর্চা করেছেন। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িকতার আপোসহীন চেতনা শত অন্ধকারের মাঝেও মশালের মতো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তিনি।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক ও স্মার্ট। ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব উন্নত চেতনা সুরুচি তাঁকে অন্য অনেকের থেকে আলাদা করেছিল। এত গুণে সমৃদ্ধ হয়েও তিনি ছিলেন নম্র ও বিনয়ী। বেশি কথা পছন্দ করতেন না। স্বল্পভাষী ছিলেন। শুদ্ধচারী ছিলেন। নিভৃতে কাজ করে গেছেন। সাংবাদিকতা পেশার প্রতি এতো ভালবাসা, এতো নিবেদন আজকের দিনে শুধু বিরলই নয়, বিস্ময় জাগানিয়া।

দেশের রাজনীতি তো বটেই, বিশ্ব রাজনীতির গতি প্রকৃতি মেরুকরণ সম্পর্কে আগাম ধারণা দিতে পারতেন। রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। সকল দৈনিক পত্রিকা তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। বহির্বিশ্বের বিখ্যাত পত্রিকা ম্যাগাজিন নিয়মিত আসতো তাঁর টেবিলে। বিশ্বগণমাধ্যমের প্রতি মুহূর্তের আপডেট তিনি জানতেন। প্রচুর বই পড়তেন। ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ রাজনীতি ধ্রুপদী সাহিত্য শিল্পকলা ইত্যাদি পাঠে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু আত্মপ্রচার পছন্দ করতেন না। পত্রিকায় নিজের ছবি ছাপানো বা টেলিভিশনে ইন্টারভিউ দিতে তাঁর অস্বস্তি হতো।

তোয়াব খান অনন্য এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। সাংবাদিকতায় কয়েকটি প্রজন্ম তিনি নিজ হাতে তৈরি করে দিয়ে গেছেন। তাঁর কাছ থেকে বহু নবীন প্রকৃত সাংবাদিকতার পাঠ নিয়েছেন। সফল সাংবাদিক হয়ে উঠেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক গণমাধ্যমে তাঁর হাতে গড়া সাংবাদিকেরা গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করছেন।

তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৪ এপ্রিল। সাতক্ষীরা জেলার রসুলপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাংবাদিকতা শুরু করেন পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক জনতা দিয়ে বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের শুরু। ষাট টাকা বেতনে সিনিয়র এপ্রেন্টিস সাব এডিটর ছিলেন। ১৯৫৫ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে পত্রিকাটির বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পান। তখন পাকিস্তান আমল। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় যোগ দেন তিনি। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের পর দৈনিক পাকিস্তান নাম বদলে দৈনিক বাংলা হয়। তোয়াব খান হন এর যোগ্য সম্পাদক। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ছদ্মনামে লেখা তাঁর ‘সত্য মিথ্যা-মিথ্যা সত্য’ ও ‘সত্যবাক’ কলাম ব‍্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়।

১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাজারে আসে দৈনিক জনকণ্ঠ। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠার একেবারে শুরুতে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে তোয়াব খানকে বেছে নেয়া হয়। তখন থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এ পত্রিকায় একই দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁর সময় জনকণ্ঠ দেশের শীর্ষ দৈনিকে পরিণত হয়। প্রতিকূল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে সুসংহত করতে সাহসী ভূমিকা রেখে চলে জনকণ্ঠ। জনকণ্ঠ থেকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে গতবছর অব‍্যাহতি নেন। পরে অনেকের অনুরোধে পুনরায় দৈনিক বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হন।

তিনি ছিলেন ভাষাসংগ্রামী। বাঙালীর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর অস্ত্র তখনও কলম। স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর লেখা ও পরিবেশনায় ‘পিন্ডির প্রলাপ’ নামে রাজনৈতিক কথিকা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস এবং মুক্তিকামী মানুষকে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার প্রতিটি নাগরিক আন্দোলনে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন তোয়াব খান। সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নিতে জোরালো ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।
সাংবাদিকতা ছাড়াও তোয়াব খান সরকার ও রাষ্ট্রের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অত্যন্ত সততা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেস সচিব নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। মহান নেতার দেশ গঠনের প্রথম পর্যায়টি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। বাঙালীর নেতা যেদিন জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে ইতিাস সৃষ্টি করেছিলেন সেদিনও সফরসঙ্গী হিসেবে অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন তোয়াব খান।

তোয়াব খান ১৯৭৭ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ পিআইবির পরিচালক পদে যোগ দেন। এর পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। একই বছর ১৯৮০ সালে তিনি সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন।

সাংবাদিকতা জগতের সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে একুশে পদক প্রাপ্ত খ‍্যাতিমান সাংবাদিক তোয়াব খান গত ১লা অক্টোবর দুপুর ১২.৪০ মিনিটে ঢাকার গুলশানস্থ ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। একমাত্র কন‍্যা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তানিয়া খানের মাথা থেকে সরে গেল পিতৃত্বের ছায়া। একমাত্র ছোট ভাই ওবায়দুল কবির খান (বাচ্চু) একা হয়ে গেলেন। শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলেন তাঁর জন্মস্থান সাতক্ষীরা রসুলপুরবাসী।

আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁকে ক্ষমা করুন ও বেহেশত নসিব করুন, আমীন।

-লেখক: সাংবাদিক, গীতিকবি ও কলামিস্ট।