Home মতামত আমেরিকার নাম কলম্বাসের নামে না হয়ে আমেরিগো’র নামে যে কারণে

আমেরিকার নাম কলম্বাসের নামে না হয়ে আমেরিগো’র নামে যে কারণে

44

সোহেল সানি:

কলম্বাস, আমেরিগো, ওয়াশিংটন। এরা তিনজন মার্কিনীদের কাছে বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব ও জাতীয় বীর। এঁদের মধ্যে মার্কিন ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্ববরণকারী ব্যক্তিটি কে? ইতিহাসের দিকে চোখ রাখা যাক। না, এঁরাও ইতিহাসে মহাবীরত্বের জন্য স্কীকৃতি পায়নি জীবদ্দশায়, যা পাওয়ার কথা যেভাবে। কলম্বাস ও আমেরিগো দুজন এ ভূখন্ড আবিস্কার করেন স্পেনের উপনিবেশ হিসাবে। রাণী ইসাবেলার রাজত্বকালে। ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকালেই ‘আমেরিকা’ নামক দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের রাজত্বকালে স্পেন যুদ্ধে পরাজিত হয়। কলম্বাস, আমেরিগো ও ওয়াশিংটন, প্রত্যেকেরই প্রাপ্তি যা কিছু তা মহাপ্রয়াণের পর। জীবদ্দশায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন যে ব্রিটিশদের যুদ্ধে পরাস্ত করে আমেরিকানদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, সেই আমেরিকান জনগণই তাঁর মৃত্যু কামনা করে টোস্টপান করেছে। তাঁর কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে।তাঁকে ব্রিটিশদের “দালাল” বলে অসম্মান করে। অতি নিষ্ঠুর পরিণতিবরণ করেছেন আমেরিকার আবিস্কারক কলম্বাসও। তিনি যে স্পেনকে বিশাল ভূখন্ড উপহার দিয়েছেন সেই স্পেনীয়রাই তাঁকে বেইজ্জতি করেছে পশুর মতো আচরণ করে। কলম্বাসকে গরুছাগলের মতো হাত-পা বেঁধে স্পেনের রাণী ইসাবেলার দরবারে হাজির করা হয়েছিল। কলম্বাস হাঁটু গেঁড়ে মহারাণীর কাছে কেঁধে কেঁদে বলেছিলেন,” এটাই কি আমার পুরস্কার।” কলম্বাস ভুল করে তাঁর আবিস্কৃত ভূখন্ডকে ” ভারতবর্ষ” মনে করায় ভূখন্ডের নাম রাখা হয় যে আমেরিগোর নামে, সেই তিনি স্পেনীয়দের কাছ থেকে নিগৃহীত হন নানাভাবে। তবে মৃত্যুর পর তিনজনই ইতিহাসের মহানায়ক,নিজের দেশের মানুষের কাছে। যে মানুষের কল্যাণেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোকে উৎস্বর্গ করেছেন তাঁরা। সব দেশেরই স্থপতি বা এরকম মহানায়কদের বিস্ময়কর চরম পরিণতিবরণের আশ্চর্য যোগসূত্রে রচিত হয়েছে, তা যেন এক অভিন্ন পৃথিবীর ইতিহাস। মার্কিন জাতির ইতিহাসের আদিঅন্ত অন্ধকারে।
আমেরিকা নামক ব্রিটিশ উপনিবেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে যে জর্জ ওয়াশিংটন জাতির জনকের আসনে উপবিষ্ট তাঁর পরিণতি কি? ফ্রান্স ও ব্রিটিশের মধ্যকার যুদ্ধ। এতে আমেরিকা বড় সংকটের মুখোমুখি। আমেরিকার অভিযোগ, ব্রিটিশররা ফ্রান্সের স্বাধীনতা ও অগ্রসরমান আমেরিকার নৌ চলাচল ধ্বংস করছে। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ অবশ্যম্ভবী হয়ে উঠলে প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করলেন। এতে পক্ষে- বিপক্ষে ফেডারেলিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে পড়ে দুটি উপদলে। যুক্তরাষ্ট্র সুপ্রিমকোর্টের প্রধানবিচারপতি জন জে’ কে লন্ডনে পাঠিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করানো হল। ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফেটে পড়লো সারাদেশ। বহু প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে ওয়াশিংটনের অপসারণের দাবি ওঠলো। এমনকি ওয়াশিংটনের আশু মৃত্যু কামনা করে জনতার একাংশ টোস্ট পান করলো! পররাষ্ট্র মন্ত্রী টমাস জেফারসনের নেতৃত্বে রিপাবলিকানপন্থী একটি উপদলের সৃষ্টি হলো। সেই তারাই মূলত জনতাকে উস্কে দেয়। ব্রিটিশের দালাল বলে আখ্যায়িত করা হয় জাতির জনক ওয়াশিংটনকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হ্যামিলটনের বিরুদ্ধেও একইভাবে সমালোচনার ঝড়। প্রধান বিচারপতি জন জে’রও কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হলো। এ পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন বলতে বাধ্য হলেন যে, “লোকে এই সন্ধির বিরুদ্ধে খ্যাপা কুকুরের মতো চিৎকার করছে।” পররাষ্ট্র মন্ত্রী টমাস জেফারসন পদত্যাগ করে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তুললেন।১৭৯৬ সালে ওয়াশিংটন তৃতীয়দফা প্রেসিডেন্ট হতে অস্বীকৃতি জানান এবং ১৭৯৭ সালের ৩ মার্চ তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জন এ্যাডামস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৭৮৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হবার পর তাঁর বেতন ২৫০০০ ডলার ধরা হলেও তা তিনি গ্রহণ করেননি। ১৭৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করলে মাউন্ট ভার্ননের ওল্ড টম্বে সমাহিত করা হয়। ১৮৩১ সালে তার মরদেহ বর্তমান স্থানে সরিয়ে আনা হয়। “আঘাত করে পালাও” নীতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। ১৭৮১ সালে ইয়র্কেটনে ব্রিটিশ বাহিনীর পরাজয়ের মাধ্যমে আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়। অবসান ঘটে ব্রিটিশ শাসনের। ফ্রান্স বাহিনী ব্রিটিশ সেনাপতি কর্নওয়ালিশকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করানোর বেলায় ভুমিকা রাখলে ব্রিটিশদের সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চাননি ওয়াশিংটন । আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনের নামে অঙ্কিত।
মার্কিন ভূখন্ডের আবিস্কারকের আসনে বহুজনের নাম উঠে আসলেও ঐতিহাসিকরা চূড়ান্ত রায়ে ইটালীর বন্দর নগরী জেনোয়াতে জন্ম নেয়া ক্রিস্টোফার কলম্বাসকেই বেছে নিয়েছেন। স্পেনের রাণী ইসবেলাকে যুক্তরাষ্ট্র নামক ভূখন্ডটি উপহার দিলেও এর নামককরণ করা হয়েছে দুঃসাহসিক নাবিক ক্রিস্টেফার কলম্বাসেরই রাজকীয় এক ঠিকাদারের নামে। নাম তাঁর আমেরিগো ভেসপুচি। ‘আমেরিগো’ থেকেই দেশের নাম ‘আমেরিকা।’ স্পেন তখনও ছিল একটি ছোট্ট দেশ। কলম্বাস ১৫০৬ সালের ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগে চরমভাবে নিগৃহীত হন। ১৫০৪ সালের ২৬ নভেম্বর রাণী ইসাবেলার মৃর্ত্যুর পর তাঁর পুত্র ফার্ডিনান্ড স্পনের রাজা হলে কলম্বাস চরম অবহেলা অপমান নিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। কলম্বাস ভুল করে তাঁর আবিস্কৃত বিশাল ভূখন্ডকে “ভারতবর্ষ” বলে যাওয়ায় ভূখন্ডটির নামও হয় আরেক জনের নামে। কলম্বাসের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার ফ্লোরেন্সের এক ঠিকাদার আমেরিগোর নামেই দেশের নাম রাখা হয় আমেরিকা। শুধু কলম্বাসের ধারণার স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কিউবা দ্বীপপুঞ্জকে আজ বলা হয় পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, যদিও ভারতবর্ষের এর কোন সম্পর্ক নেই। কলম্বাসের মতো আমেরিগোরও আসল দেশ ইটালী হলেও স্পেনে বাস করতেন। কলম্বাসের জাহাজেই মালপত্র যোগান দিতেন ঠিকাদার হিসাবে তিনিই। পায়ে হেঁটে হেঁটে আমেরিগো মূল ভূখন্ডের অভ্যন্তরে ঢুকে

দাবি করেন এটা কোন ভারত বা এশিয়ার দেশ নয়, এটা ভিন্ন এক পৃথিবী। যার পশ্চিমে আরও এক বিশাল সাগর, তারপর ভারতবর্ষ। কলম্বাসের মৃত্যুর ৬ বছর পর ১৫১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন আমেরিগো। স্পেনই তার ভূখন্ড হিসাবে আমেরিকার নাম রাখেন। রানী ইসাবেলা স্পেনের একটি উপনিবেশ হিসাবে নতুন বসতি স্থাপন করে রেড ইন্ডিয়ানদেরকেও খৃষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে সুসভ্য শিক্ষিত জাতি হিসাবে গড়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাণী কলম্বাসের আবিস্কৃত দেশে স্পেনের বার্গোস গীর্জার বিশপ জোয়ান ডি ফনসেকাকে রাজ প্রতিনিধি হিসাবে শাসন করার জন্য পাঠালে কলম্বাস দুঃখিত হন। বিবাদ হলো সে নিয়ে। কলম্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর হয়ে উঠলো। বিপক্ষে চলে গেলো তার শিষ্যরা। ১৪৯৬ সালের ১০ মার্চ কলম্বাস স্পেনে চলে এলেন। রাণীর কাছেও গেলেন না। ইস্পানিয়াতে রাজ্য স্থাপন করে শাসক করলেন কলম্বাসকে। ইউরোপীয় নগরীর গোড়া পত্তন ডোমিনিক্যান উত্তর উপকূল দখল করে। নাম রাখলেন ইসাবেলা নগরী। যা আজ ডোমিনিক্যান প্রজাতন্ত্র। ইস্প্যানোলার গভর্নর পদ কেড়ে নেয়া হল কলম্বাস তাঁর দলের লোকদের সন্দেহ করে হত্যা করলে। বোবাডিল্লাকে পাঠালেন গভর্নর করে। ইসাবেলা শুনতে পেয়ে চটে গেলেন। কলম্বাস ও তার ভাইদের হাত পা বেঁধে গরু ছাগলের ন্যায় স্পেনে পাঠিয়ে দিলেন গভর্নর বোবাডিল্লা। রাণীর কানে গেলো সে কথা। বোবাডিল্লাকে শাসিয়ে বলেন, তোমাকে এরকম আচরণ নিয়ে আসতে বলিনি। স্ব সম্মানে কলম্বাসে হাজির কর। রাজা রাণীর দরবারে হাঁটু গেড়ে বসে কেঁদে বললেন পশুতুল্য আচরণ কি আমার পুরস্কার। রাণী বললেন আমি দুঃখিত। তুমি ফিরে যাও ইস্প্যানোলাতে শাসক হয়ে। কলম্বাস বললেন, মহারাণী তা হয় না। অপমান নিয়ে আর আমি যাবো না। তোমাকে যেতে বোবাডিল্লাকে শাস্তি আমি দেব। কলম্বাস তোমার শত অপরাধ আমার কাছে ক্ষমার যোগ্য। নতুন বিশ্ব আবিস্কারককে আমি কষ্ট দিতে পারি না। জ্যামাইকা পৌঁছার পর এলো মহারাণীর মৃত্যুর খবর। দু’ বছর পর তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলো।১৪৯২ সালে আমেরিকা আবিস্কারের পর থেকেই চোখ পড়লো ইংল্যান্ডের। তখন তাদের কোন উপনিবেশ নেই অথচ স্পেন একের পর এক নিজেদের আধিপাত্য। ১৫৫৮ সালের ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ মহামান্য পোপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে আমেরিকার দিকে চোখ রাখলো। আর ভাবলো স্পেনের অধিকৃত আমেরিকা তার চাই। ফ্রান্সও স্পেনের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডের সঙ্গে হাত মিলালো। তখন স্পেন রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ। ১৫৮৫ সালে ২৫টি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে দুঃসাহসিক ফ্রান্সিস ড্রেক স্পেনকে পরাভূত করেন। একদিন হয়ে উঠলো বৃটিশ উপনিবেশ। জর্জ ওয়াশিংটন ইংল্যান্ডে জন্ম নিলেও ব্রিটিশদের অধীনতার বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা এনে দেন জর্জ ওয়াশিংটন, তিনি হলেন সমগ্র মার্কিন জাতির জনক। মার্কিনীদের জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটন। তাঁর নামেই আমেরিকার রাজধানী-যার নাম ওয়াশিংটন ডিসি।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।