Home মতামত আমাকে মনোনিত করায় গর্ব বোধ করছি

আমাকে মনোনিত করায় গর্ব বোধ করছি

77

শামীমা সুলতানা: আমরা নিজেদের বলতে ভালোবাসি আমরা ‘মাছে ভাতে বাঙ্গালি’! নদী মাতৃক দেশ আমাদের। এখানকার পলি জমা উর্বর মাটি হওয়ায় আমাদের দেশের মানুষরা দানাদার শষ্যের সাথে খাদ্যাভাসে যুক্ত করে নিয়েছেন নদী-নালা খাল-বিল বা জলাশয়ে পাওয়া নানান ধরনের মাছ। কিন্তু ক্রমোবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে খাদ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ শুধুই প্রকৃতির ওপর নির্ভর না থেকে নিজেরাই গড়ে তুলছেন শষ্য বা মাছের খামার। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই অর্জনে যাদের ভুমিকা সব থেকে বেশি তারা হলেন এদেশের কৃষক, খামারি এবং মৎস চাষীরা। এই মানুষগুলোর পাশে থেকে যারা ভুমিকা রাখছেন তারা হলেন দেশের কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী এবং সরকারী, বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠান। এদেশেরা কৃষক এখন খোরপোশ কৃষি থেকে বেড়িয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে এগোচ্ছে। কয়েক দশকে নিরবেই বিপ্লব ঘটে গিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি খাত। আর এই বিপ্লবের নিরব গল্পগুলো তুলে ধরছি অনুঘটক হিসেবে আমরা যারা গনমাধ্যম কর্মীরা আছি।

কৃষি এবং গণমাধ্যমের সাথে আমার পথ চলা শুরু ২০১৫ সাল থেকে। কখনও ভাবিনি এই পেশায় কাজ করবো। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকদের প্রতি এতটা দরদ অনুভব করবো তা আগে ভাবনাতে ছিলো না। আজ তারই ধারাবাহিকতায় ফোয়াব সম্মাননা’ ২০২২ আমাকে মনোনিত করায় গর্ব বোধ করছি। কারণ প্রথম বারের মতন কোন সংগঠন আমাকে সম্মানিত করার জন্য মনোনিত করেছেন। আরো ভেবে অবাক হয়েছি যে সরাসরি মৎসচাষীদের চোখে আমি নির্বাচিত হয়েছি!! এই সম্মাননা শুধু আমার একার নয় এটি আমাদের দীপ্তকৃষি পরিবারের সকলের। কারন আমরা দীপ্তটিভির কৃষিটিম ৭টি বছর ধরে তুলে ধরার চেষ্টা করছি কৃষক, খামারী ও মৎস জীবিদের সংগ্রামী জীবনের গল্প। ছুটে গিয়েছি দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। নদী, পাহাড়, সমতল সবখানেই আমাদের পদচারণা ছিলো দৃপ্তপদভারে।

মৎস্য চাষীদের নিয়ে আমার ভাবনা বরাবরই ছিলো একটু ভিন্নরকম। প্রতি মাসেই যখন ঢাকার বাহিরে বিভিন্ন জেলায় কৃষির ওপর প্রতিবেদন করতে যেতে হয়, তখন কিছু মানুষদের কথা সবসময় মনের ভিতরে থেকে যায় আমার। তারা হলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জেলে পরিবার। নিজ চোখে দেখেছি, অনুভব করেছি এবং খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি সে সকল অসহায় মানুষদের অন্তরকথন। ২০১৬, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে টানা ৩ বছর বেশকিছু কাজ করেছিলো দীপ্তকৃষি টিম। অঞ্চল ভিত্তিতে মৎস্য চাষী এবং জেলেদের গল্প উঠে এসেছে দীপ্তকৃষির সে সকল অনুষ্ঠানে। এখনও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে।

নদী এদেশের প্রাণ। নদীমাতৃক এদেশে শাখা-প্রশাখা সহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার একশত ৪০০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে প্রবাহিত প্রবাহিত হচ্ছে। নদী কেন্দ্রিক মানুষদের জীবন ও জীবিকার বড় একটি অংশ হচ্ছে মৎস্যজীবী। ‌দেশের সমুদ্রকে কেন্দ্র করে উপকূলবর্তী জেলার মৎস্যজীবী এবং নদীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত মৎস্যজীবীদের কাছে গিয়েছি শুনেছি তাদের মুখ থেকে তাদের জীবন সংগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন কথা। মাছ ধরতে গিয়ে অনেক সময় জেলেদের পরতে হয় ডাকাতের কবলে অথবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার ভেতর প্রতিকূল পরিবেশে অনেক সময় প্রাণ হারান মৎস্যজীবী মানুষগুলো। কিন্তু তাদের নেই কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয় জলমহলগুলো মৎস্যজীবীদের কাছে ইজারা প্রদান করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এগুলো চলে যায় সম্পদশালীদের কাছে ফলে প্রকৃত জেলেরা নানাভাবে বঞ্চিত হয় সম্মুখীন হন নানামুখী সংকটের।

জেলেদের অনেকে আছেন যারা শুধুমাত্র মৌসুমে ইলিশ আহরণের উপর নির্ভরশীল। মা ইলিশ রক্ষার জন্য বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকে ইলিশ মাছ আহরণ-বিপণন ও পরিবহনে। এইসাময়িক অসুবিধা দূরীকরণে এ সময়ে জেলেদের সহযোগিতায় সরকার ভালো কিছু উদ্যোগ নিলেও দীপ্ত কৃষির ক্যামেরায় উঠে এসেছিল অন্য রকমের এক চিত্র। আমরা দীপ্ত কৃষি টিম যখন ইলিশ সংগ্রহকারী জেলেদের সাথে কথা বলেছিলাম তখন তাদের ভাষ্যমতে সরকার থেকে যে সকল সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা সঠিক সময়ে কখনোই তা পায়নি। আবার অনেকে জেলে কার্ডও পায়নি। সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেক জেলে আবার কার্ড থাকলেও কার্ডের যে সুবিধা তা পাননি তারা।

আমার মনে পরে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ফেরিঘাট এলাকাতে বেশকিছু মৎস্যজীবীদের নিয়ে একটি মতবিনিময় অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলো সেখানকার প্রান্তিক মৎস্যজীবীরা এবং সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু কর্মকর্তাগণ। তাদের সকলের উপস্থিতিতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা হয়। তাদের মতে যে সময় ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা থাকে সেসময় বড় মাছ ধরার একটি মৌসুম থাকে যেমন রুই, কাতল, বোয়াল। তাদের ভাষ্যমতে যে জাল দিয়ে তারা মাছ ধরবেন সে জালে ইলিশ ধরা পড়ে না তা সত্ত্বেও নদীতে নামতে দেয়া হয়না মাছ না ধরার জন্য। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেই সকল মৎস্যজীবীরা। মহাজনী সুদ, ঋণগ্রস্ততা সবমিলিয়ে তারা খুব কষ্টের সময় পার করে কারণ সে সময় তারা নদীতে নামতে পারে না আবার সেই সময়ই যে সময় তার নদীতে নামতে পারছেন না ঠিক সে সময় উপার্জনের একটি ভাল পথ তাদের বন্ধ হয়ে যায়।

জামালপুরের মৎস্যজীবীরা বলেছিলেন একটু ভিন্ন রকমের কথা। সমবায় সমিতির মাধ্যমে তারা তাদের সমস্যা নিরসন করতে চান পাশাপাশি সরকার থেকে মৎস্যজীবীদের জন্য বীমার সুযোগ-সুবিধা করে দিলে তারা আরো বেশি উপকৃত হতেন। যা এ সংক্রান্ত একটি হোলটেবিল আলোচনার মাধ্যমে দীপ্ত টিভিতে তুলে ধরেছিলাম।

২০১৬ সালে আমরা গিয়েছিলাম ভোলার ইলিশা ঘাটে সেখানে জেলে কামাল মাঝির সাথে কথা বলতে বলতে তার ছোট্ট ট্রলারে করে নদীতে এগোতে থাকি। হঠাৎ দেখলাম চারপাশ অন্ধকার হয়ে ঝড় শুরু হয়েছে, ঠিক সে সময়ই আমরা আসলে মেঘনা নদীতে। কামাল মাঝির সাক্ষাৎকার নিতে নিতে কখন যে মাঝ নদীতে চলে এসেছি তা গল্পে গল্পে টেরই পাইনি। প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ি সেদিন। ক্যামেরা গুটিয়ে ত্রিপল এর মধ্যে সবাই মাথা ঢুকিয়ে স্রষ্টাকে স্মরণ করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। অন্ধকার ঘরের মধ্যে মনে হচ্ছিল ট্রলারটি অনেক উপরে উঠছিল এবং নিচে নামছিল। দীপ্ত কৃষি টিমের ৬ সদস্যসহ সেদিন ট্রলারে ছিল জেলে কামাল ভাই। সেই মুহূর্তে আমি অনুভূতিহীন ছিলাম, শুধু চারপাশটা দেখছিলাম। প্রায় এক ঘণ্টা সময় ছিল আমাদের সেই শ্বাসরুদ্ধকর ঝড়ের পথ। মেঘনার অমন রূপ আগে কখনো দেখা হয়নি আমার। তীরে ফেরার পর যখন কামাল ভাইয়ের সাথে তার বাড়িতে যাই, তখন ভাবিকে বললাম আজ তো আমরা ঝড়ের কবলে পড়েছি, এধরনের কি প্রায়ই কামাল ভাইকে পড়তে হয়? আর তখন তার সহধর্মিনী বললেন আমাগো পথ চাইয়া থাকতে হয়…আপদ-বিপদতো থাকবোই। তাই বলে তার নদীতে যাওয়া বন্ধ থাকবো না।

রাতে যখন গেস্ট হাউজে ফিরে সারা দিনের কথা ভেবে আতঙ্ক অনুভব করছিলাম। এই মানুষগুলো দুবেলা ডাল ভাত খাওয়ার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই দিনের পর দিন সংগ্রামী জীবন যাপন করে যাচ্ছেন। অথচ তাদের জন্য কি আমাদের করণীয় কিছুই নেই?? সে প্রশ্ন হয়তো থেকেই যাবে।

আমার কাজের ধারাবাহিকতায় আমি ছুটে গিয়েছি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের বাণিজ্যিক মৎস্য খামারিদের কাছে। এখন মাছ চাষের ক্ষেত্রে অনেক আধুনিক উপায়ও মাছ চাষ করছেন মৎস্যজীবীরা। সাথে যুক্ত হয়েছে কাঁকড়া-কুচিয়ার রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খামার।

খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমাদের এই দেশ একটা সময় উন্নত দেশ হবে। কিন্ত যে মানুষদের জন্য আজ এগিয়ে যাচ্ছে দেশ সেই মানুষগুলোর সুখ দুঃখের কথাগুলো ভাবা খুব জরুরী। তাদের সাফল্য, তাদের সংকট এবং সংকটগুলো থেকে বেরিয়ে কি করে নিজেদের ভালো অবস্থানে নেবেন এবং দেশের প্রতি অবদান রাখবে সেই বিষয়গুলো হয়তো গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে তুলে ধরা এবং সেই মানুষগুলোকে উৎসাহিত করার গুরুদায়িত্ব আসলে আমাদের। তাই মৎস্য সম্পদের টেকসই উন্নয়নে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার সুষ্ঠু ও সঠিক বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। -লেখক: প্রযোজক ও ইনচার্জ,দীপ্ত কৃষি অনুষ্ঠান, দীপ্ত টেলিভিশন।