স্টাপ রিপোর্টারঃ আজ পহেলা বৈশাখ। উৎসব-আনন্দের দিন, মহামিলনের দিন। পুরাতনকে ভুলে নব উদ্যোমে এগিয়ে চলার দিন। গেল ৩ বছর বাঙালি প্রাণের বর্ষবরণ উৎসব পালন করতে পারেনি মরণঘাতী করোনায়। এবার সেই অনামিশার অন্ধকার কেটে বাঙালি উৎসবে ফিরবে চিরচেনা রূপে। রমজানের কারণে এবারো উৎসব-আয়োজনে কিছুটা কমতি হলেও মানুষের হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে কোনো কমতি থাকবে না। নানা বিধিনিষেধের পরেও সমগ্র জাতি আজ মেতে উঠবে নব আনন্দে। রমনা বটমূল, টিএসসি, রবীন্দ্র সরোবর সহ রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোতে মহামিলনের ঢল নামবে। বৈশাখ কেবল উৎসব নয়, বাঙালি জাতিসত্ত্বার স্মারক। হিন্দু কিংবা ইসলাম, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান-মানুষ আজ ভুলে যাবে ধর্মের বিভেদ। এজাতির একটাই পরিচয় বাঙালি। হাতে হাতে ধরে আবহমান কাল থেকে বাঙলি এভাবেই চলতে অভ্যস্ত। ধর্মের দেয়াল তুলে বাঙালিকে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বিভাজনের বেড়াজালে বন্দী রাখতে চাইলেও এই সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবে-বাঙালি বেরিয়ে আসবে সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যের কাতারে। জেগে উঠবে নব আনন্দে, নবপ্রেরণায়। নতুন দিনের নতুন শপথে। সে শপথ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক হায়েনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার বাণীতে দেশবাসীকে নবপ্রেরণা-নবঅঙ্গীকারে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি তার বাণীতে বলেন-“পহেলা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন, মহামিলনের দিন। এদিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে, নব-অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতাকে ভুলে সবাইকে আজ নবআনন্দে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানাই।”

মোগল সম্রাট আকবর ‘ফসলি সন’ হিসেবে বাংলা সন গণনার যে সূচনা করেন-তা সময়ের পরিক্রমায় আজ সমগ্র বাঙালির কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক স্মারক উৎসবে পরিণত হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন,  বাঙালির আত্মপরিচয় ও শেকড়ের সন্ধান মেলে এর উদযাপনের মধ্য দিয়ে। পহেলা বৈশাখের দিকে তাকালে বাঙালি তার মুখচ্ছবি দেখতে পায়।”

মহামারি করোনা পর এবার রাজধানীসহ সারা দেশে বর্ণিল আয়োজনে হচ্ছে বাংলা নববর্ষ-১৪২৯ উদযাপন। ইতোমধ্যে এর প্রস্তুতিও সম্পন্ন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রত্যুষে রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজন, আর সকালে বেলা বাড়ার সঙ্গে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে বরণ করা হবে বাংলা বছরের প্রথম দিন।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলা নববর্ষ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এবার বর্ষবরণে রাজধানীর পাশাপাশি দেশব্যাপী বর্ণিল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। ছায়ানটকে রমনার বটমূলে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করার অনুমোদন দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এছাড়া বর্ষবরণের অংশ হিসেবে দেশজুড়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা (নববর্ষ ও বঙ্গবন্ধু), সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ মেলার আয়োজন করা হবে। নববর্ষের ব্যানার, ফেস্টুন দিয়ে সুসজ্জিত করা হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নগরের কেন্দ্রস্থল।

ছায়ানটের এবছরের বর্ষবরণের প্রতিপাদ্য ‘নব আনন্দে জাগো’। এর উপর ভিত্তি করে পুরো অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে ভোর সোয়া ৬টায়। শেষ হবে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলাও বর্ষবরণের মূল আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রার কাজ শেষ করে পুরো প্রস্তুতি নিয়েছে। জয়নুল গ্যালারির সামনে চারুকলার শিক্ষার্থীরা হাতপাখা ও চরকি তৈরি করছেন, সরাচিত্রসহ  নানা মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন মাছ, ফুলসহ নানা মোটিফ। বাঘ, সিংহসহ নানা রকমের মুখোশে রঙ-তুলির আঁচড়ে ব্যস্ত শিক্ষার্থীরা কেউ কেউ। এবার শোভাযাত্রায় ঘোড়া ও টেপা পুতুলসহ মোট পাঁচটি বড় মোটিফ থাকছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মেট্রোরেলে নির্মাণকাজের জন্য শোভাযাত্রার গতিপথে খানিকটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে আনন্দময় পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। সকাল ৯টা চারুকলার সামনের রাস্তা সরু হয়ে আসায় টিএসসির মোড় থেকে রাজু ভাস্কর্যকে পেছনে রেখে শুরু হয়ে ভিসির বাড়ির সামনে গিয়ে আবার টিএসসিতে এসে শেষ হবে শোভাযাত্রা।

বাংলা একাডেমি, কবি নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এবারের নববর্ষের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর আগে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ধানমণ্ডি রবীন্দ্র সরোবরে বৈশাখ উদযাপন করা হলেও এবারের আয়োজন হচ্ছে না।

বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে ‘ইনটানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এ অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে আজ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের সকল জেলা,উপজেলা ও ইউনিয়নে বৈশাখী র‌্যালি আয়োজন করা হবে। এছাড়া কুইজ প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লোকজ মেলার আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) কর্তৃক বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এবং বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রাঙ্গণে নববর্ষ মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।

এছাড়া বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আরকাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, কপিরাইট অফিস ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আলোচনাসভা, প্রদর্শনী, কুইজ, রচনা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট বা একাডেমিসমূহ তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে।

সবমিলিয়ে বাঙালি অনেক দিন পর আবার প্রাণের উৎসবে মেতে উঠবে। আজকের মহামিলন সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ষড়যন্ত্রের দেয়াল ভেঙে এগিয়ে চলবে নতুন লড়াইয়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে। সে লড়াইয়ে অতীতের মতোই সামনে থাকবে তারুণ্যের শক্তি-এটাই  অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালি জাতির।