Home জাতীয় আইনি বৈধতা পাচ্ছে আগের সার্চ কমিটি ও ইসি

আইনি বৈধতা পাচ্ছে আগের সার্চ কমিটি ও ইসি

29

ডেস্ক রিপোর্ট: বিএনপিদলীয় সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের আপত্তির মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে করা আইনের খসড়া গতকাল রবিবার বিল আকারে সংসদে তোলা হয়েছে। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’ উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। পরে বিলটি সাত দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। সংসদীয় কমিটিকে সাত দিন সময় দেওয়া হলেও কমিটি চাইলে আগেই সংসদে প্রতিবেদন দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে কয়েক দিনের মধ্যেই বহুল আলোচিত বিলটি পাশ হতে যাচ্ছে। আর বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার পর সেটির ভিত্তিতেই গঠন হবে নতুন নির্বাচন কমিশন।

উত্থাপিত বিলটিতে এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠন করা সর্বশেষ দুটি ইসি গঠনেরও বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এর আগে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটি, তাদের কাজ এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সিইসি ও কমিশনার নিয়োগ বৈধ ছিল বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। আগের সার্চ কমিটির ‘বৈধতা’ দেওয়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী সংসদে বলেন, ‘দুবার যে সার্চ কমিটি করা হয়েছিল, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সেটাকে আইনসিদ্ধ করা হচ্ছে।’
২০১২ এবং ২০১৭ সালে সার্চ কমিটির মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি যে ইসি নিয়োগ করেছিলেন—সেই প্রক্রিয়ার বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি একই প্রক্রিয়ায় ইসি গঠনের বিষয়টিকে আইনি কাঠামো দিতেই বিলটি সংসদে তোলা হয়েছে। বিলটিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আইনে তিনটি যোগ্যতা এবং ছয়টি অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে।
এ আইন করার উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বিলে বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত বিলটি আইনে পরিণত হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগদান স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে, গণতন্ত্র সুসংহত ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে এবং জনস্বার্থ সমুন্নত হবে মর্মে আশা করা যায়।’

বিলটি প্রত্যাহার ও বর্তমান ইসি সদস্যদের আইনের আওতায় আনার দাবি

বিলটি উত্থাপনের বিরোধিতা করে বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদ বলেন, ‘যে বিল আইনমন্ত্রী এনেছেন, তা জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের যে প্রত্যাশা, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আজ আইনমন্ত্রী যে বিল উত্থাপন করেছেন, এরই মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয়েছে—যাহা লাউ, তাহাই কদু।’

হারুন বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এই আইন আনা হয়েছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। এর আগে যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অনুরূপ বিল এখানে তোলা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা জরুরি বলে দাবি জানান তিনি।

বিএনপিদলীয় এই আইনপ্রণেতা আরো বলেন, এ আইন প্রশ্নবিদ্ধ। এ আইন দিয়ে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে না। সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আমি দাবি করব—আইনটি প্রত্যাহার করুন। আইনমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, এরকম একটি আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ কথা বলার পর তিনি কী করে এ আইন আনেন?

আইন হলে বিএনপি ভোট চুরি করতে পারবে না: আইনমন্ত্রী

হারুনের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক খসড়া আইনের বিভিন্ন ধারা পড়ে ব্যাখ্যা করেন। আইনমন্ত্রী কথা বলার সময় তার সামনের আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুল হককে বিভিন্ন বিষয় মনে করিয়ে দেন ও বক্তব্যের কিছু পয়েন্ট দেন। বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, কোথাও এরকম স্বচ্ছভাবে ইসি গঠন করার পদ্ধতি নেই। এই আইন হলে এবং এর মাধ্যমে ইসি গঠিত হলে বিএনপি ভোট চুরি করতে পারবে না, এজন্যই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।

আনিসুল হক বলেন, বিএনপি নিজেরা নির্বাচনে জয়ী হতে ১ কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল। নিজেদের পছন্দের মানুষকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিল। এগুলো কারো সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়নি। আলোচনার প্রয়োজনও মনে করেননি। নির্বাচনে কারচুপি করে ক্ষমতায় আসার জন্য এসব করেছিল বিএনপি।
আইনমন্ত্রী আরো বলেন, সংবিধানে বলা আছে—নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে হবে। আমরা সেই আইন করেছি। ওনারা বুঝে বলুন, না বুঝে বলুন, বলছেন এটা সার্চ কমিটির আইন। ওনারা বলছেন, আইনটা আমরা ঠিক করিনি। ওনাদের সঙ্গে আলোচনা করিনি। তিনি বলেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আমার কাছে একটি ড্রাফট দিয়েছিল। তখন আমি বলেছিলাম—এই আইন সংসদে না এনে করা ঠিক হবে না। সবার সঙ্গে আলোচনা করে তারপর সংসদে আনা উচিত।
সার্চ কমিটি গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, তখন একটা কনসেনশাস হয়েছিল। তখন গেজেট হলো। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। পরেরবার আবার একইভাবে হলো। এটা আইন ছিল না, কিন্তু এটা ছিল ‘ফোর্স অব ল’। কারণ এটি রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে বড় কেউ না। তখন বিএনপির আপত্তি ছিল না।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি যে দুইবার সার্চ কমিটি করেছেন, সেটাও আইনসিদ্ধ ছিল। সেটাও আইনের আওতায় আনা হলো। এটা কনসেনশাসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। উনাদের কথা হচ্ছে, যা করেন করেন, তালগাছ আমার। তালগাছ উনাদের না। তালগাছ জনগণের। উনারা না বুঝে বলছেন। আইনটা যখন করে ফেললাম, পালের হাওয়া চলে গেছে। সেজন্য এখন কী বলবেন। এইটা নাই, ঐটা আছে। ঐটা নাই, এসব নাচগান শুরু করে দিয়েছেন।’ বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, উনারা চান উনাদের পকেটে যে নাম, সেই নাম দিয়ে ইসি গঠিত হবে। সেটা হবে না। এটা বাংলাদেশ। জনগণ ঠিক করবে। কোনো দল অগ্রাধিকার পাবে না।
সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, কমিটির চার জন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেও তাদেরকে চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি পছন্দ না করলেও ১০ জনের ভেতরে তাকে থাকতে হবে। সার্চ কমিটির বিধান তুলে ধরে আনিসুল হক বলেন, ‘উইদাউট প্রেজুডিস বলছি, যদি কোনো নির্বাচন কমিশনার কোনো অন্যায় করে থাকেন, তাহলে কী তাকে এই আইনের ৯ দফায় ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছে?’
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনিয়মের বিচারের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে আজিজ কমিশনের বিচার করতে হবে। ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের বিচার করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় ওঠা যাবে না। সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠতে হবে।’ এই বিতর্কের পরে কণ্ঠভোটের মাধ্যমে বিলটি সংসদে উত্থাপনের জন্য অনুমতি পান আইনমন্ত্রী।

সার্চ কমিটি গঠন ও কর্মপ্রক্রিয়া
বিলে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করবেন। সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দুজন করে মোট ১০ জনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন- প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তিন জন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।
বিলটিতে বলা হয়, সার্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করবে। আইনে বেঁধে দেওয়া যোগ্যতা, অযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সুনাম বিবেচনা করে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। কমিটি গঠনের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে দেবে। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটি সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার পদে যোগ্যদের অনুসন্ধানের জন্য রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী সংগঠনের কাছ থেকে নাম আহ্বান করতে পারবে। আর কমিটির কাজে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যতা-অযোগ্যতা

আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো— বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, নূন্যতম বয়স হতে হবে ৫০ বছর এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এসব যোগ্যতা থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।

প্রস্তাবিত আইনে সিইসি ও কমিশনার পদের জন্য ছয়টি অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো—আদালত অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করলে, দেউলিয়া হওয়ার পর দায় থেকে অব্যাহতি না পেলে, কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা বিদেশি রাষ্টেÌর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করলে, নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট-১৯৭৩ বা বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনালস) অর্ডার-১৯৭২-এর অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে এবং আইনের দ্বারা পদাধিকারীকে অযোগ্য ঘোষণা করছে না, এমন পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে। এমন অযোগ্যতা সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।’ সংবিধানে ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের কথা বলা থাকলেও স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই আইন করার উদ্যোগ নেয়নি। নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত যেই ২৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তাতেও বেশির ভাগ দলই আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে। সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ১৭ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।-ইত্তেফাক