Home মতামত অনুগল্প: ১৮ নং বিসিসি রোড

অনুগল্প: ১৮ নং বিসিসি রোড

55

পলাশ কলি হোসেন শোভা: সব সময় আমাদের বাসাটা ছিলো আনন্দ আর আড্ডায় ভরা অনেকগুলো ভাইবোন থাকলে যা হয়। আব্বা সকালে অফিসে যাবার জন্য তৈরী হতেন বেশ আগে থেকেই এর একটা কারণ অবশ্য ছিলো তাহলো, ঠাটারিবাজারের রাস্তা গুলো খুব একটা প্রশস্ত ছিলো না। অফিসের গাড়িতে আব্বা সব সময় আসা যাওয়া করতেন, রাস্তায় যেন অনেকক্ষণ গাড়ি দাড়িয়ে থেকে জ্যাম না বাধায় তাই জলদি আব্বা বের হয়ে যেতেন।

এর পরেই তিন বোন এক ভাই স্কুলে চলে যেতাম। বিকেল হলেই পারুলদের বাসায় গল্প করতে যেতাম। পারুলের অনেক আত্নীয় স্বজনরাও আসতো, আর জমে উঠতো গল্পের আসর। নেহাল ছিলো পনির ভাইয়ের বন্ধু তাই সেও আসতো। পারুলের খালারা ছিলো খুব আধুনিক মনস্ক মানুষ । তখন আমি মাএ বড় হচ্ছি চার পাশের পৃথিবী তখন ও চিনি না। যা দেখি তাতেই অবাক হই, এমন অবস্হা। ওর পুস্প খালা ওনার হাসব্যান্ডকে ইউসুফ ইউসুফ বলে চিৎকার করে ডাকতো।

প্রথম দিকে ভেবেছিলাম হয়তো বাসার কাজের লোক কে ডাকছে। পারুল কে জিগ্যেস করলাম খালা কাকে ডাকে এভাবে ? হাসতে হাসতে পারুল বললো, কেন খালুকে।

আমি এত অবাক হয়েছিলাম যে বলার নয়। তখনও আমি জানতাম না স্বামীকে এভাবে ডাকা যায়! আমাদের পরিবারে এভাবে ডাকার রেওয়াজ ছিলো না। এখন তো এটাই প্রথা হয়ে দাড়িয়েছে। এভাবে ই দিন যায়। একটা সময় আমরা বিসিসি রোড ছেড়ে মহাখালি টিবি হসপিটালে ডাঃ কোয়ার্টারে চলে এলাম। দাদা ওখানে জয়েন করেছেন। আমিও কলেজে ভর্তি হবো। বকশীবাজার কলেজে ভর্তি হলাম। মাএ কয়েক দিন ক্লাস করলাম।

বন্ধু নেই শুধু ফ্লোরার সাথে বন্ধুত্ব হলো। সাহিদা ওবায়েদ ম্যাম ইংলিশ পড়ান।ক্লাসের মেয়েরা ওনাকেই দেখতে ব্যাকুল। আমি ওখানে না পড়ার মনস্হ করি। কারন কলেজটাতে দুটো গ্রুপ আজিমপুর স্কুল আর অগ্রণী স্কুলের রেষারেষি। চলে এলাম বাসার কাছে তিতুমীর কলেজে ট্রান্সফার হয়ে।

একদিন দেখি রুবেল কে। সেও এখানেই পড়ছে। ঠাটারিবাজার থেকে মহাখালী কেমনে সম্ভব? প্রায় ও দুপুরে আমার সাথে চলে আসে। খেয়ে দেয়ে প্রাকটিকাল ক্লাসে যায়।

একদিন ছুটির দিন। নেহালের আম্মা আমাকে যেতে বলেছে। দুপুরে গিয়ে সোজা রান্না ঘরে। গল্প করা শুরু করলাম। খালাম্মা নিজে রাঁধতে পছন্দ করতেন। তিন চারজন লোক থাকা স্বত্বেও। এই বাড়ির আরেক জন চমৎকার মানুষ জুয়েলদা।আমরা সবাই দাদু বলেই ডাকতাম। যুদ্ধাহত মুক্তি যোদ্ধা। মুখে হাতে মারাত্মক ক্ষত ছিলো। বুলগেরিয়া সরকার চিৎকিসা করে অনেকটাই সুস্থ করে তোলেন। রবীন্দ্র সংগীত পাগল। সারাদিন গান নিয়ে থাকেন। আমাকে এত স্নেহ করতেন, এজীবনে ভোলার নয়।

খেতে বসেছি ভাইয়াও আছে। আর ভাইয়া মানে বাঘ। সবাই চুপ। কেউ কথা বলছে না। রুবেল ইশারায় বলছে ঠিক মত খা।
প্রচুর খাবার ছিলো। খালাম্মা বললো,
শোভা মুরগীর মাথা খাবি? দেই?
সাথে সাথে ভাইয়া বলে বসলো, ওরে আর মাথা দিয়েন না, চারিদিকে সবার মাথা চিবাইয়া খাইতেছে।
ভাইয়া এমন কথা বলতে পারে! সবাই একসাথে ওনার দিকে তাকালো।
ভাইয়া কি বললেন এইটা?
খা কথা কইস না।

ভাইয়া সিনেমার হিরো! ঘরের আটপৌরের জীবনে তা বিশ্বাস হবার নয়। নিজের একটা আলাদা জগৎ ওনার। বেশি সময় বাসায়ই থাকতে দেখেছি। যদিও অনেক কানা ঘুষা শুনতাম। হাজার হোক হিরো তো। তবে ঘরে উনি দায়িত্ব শীল বড় ভাই।

মাসুদ রানা তৈরি হচ্ছে কবরী আছেন। আর কলকাতা থেকে আরেকজন এসেছিলো ঝুমা মুখার্জি নাম। ঠাটারিবাজারের বাসায় সাইড নায়িকার থাকার ব্যবস্হা। এরে নায়িকা হিসেবে আনলো কে? দুধে আলতায় রঙ বাকিটা সবই বাতিলের পর্যায়ে ।সুমিতা দেবীর সিলেকশন।

আমি যেহেতু খুব ওবাড়িতে যেতাম একসময় ঝুমার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। তখন নেহালও দেশে ছিলো। আমারে শুধু বলতো, ওই তুই ওনার সাথে মিশবি না।

মেলামেশা কমছিলো আগে থেকেই নেহাল একদম ওনাকে সহ্য করতে পারতো না। ওদের আরেক ভাইয়ের সাথে ঝুমার ইটিশপিটিশ হতেই ভাইয়া বাসা থেকে সরিয়ে দেন। সংসারের সব দিকে উনি খেয়াল রাখতেন। কলকাতার ১৭ হেমসেন লেন এ ওর বাসা ছিলো। আমাকে চিঠি দিয়েছিলো অনেক গুলো আমিই রণে ভঙ্গ দিলাম।

মহাখালির টিবির ভেতরের পরিবেশ এত সুন্দর এত পরিচ্ছন্ন যে মন বসতে সময় নেয় নি। তবে সব ডাঃ দের বউ আমাদের সবার হয় ভাবী। এই ভাবী আর তাদের বাচ্চাদের সাথে আমি প্রভা খেলা শুরু করে দিলাম বিকেল বেলা। কি খেলা?।
কেন গোল্লাছুট , সাতচাড়া, ছি বুড়ি ছোঁয়া ছুয়ি কিংবা দৌড়াদৌড়ি।
দিন যায়, জীবন যায়, সময় যায়, আমিও হতে থাকি সময়ের সাথে সাথে বড়।

-লেখক : অধ্যাপক (অব) মীরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।