দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ অদ্ভুত রকমের ব্যস্ত এই ঢাকা নগরীতে পারতপক্ষে বাইরে বের হতে মন চায় না। আবার বাইরে গেলেও কত তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরবো সেই তাড়ায় থাকি। ঘর মানে পাখির বাসার মত ছোট্ট নীড় কিংবা ছোট্ট অফিস কামরা। এমনটি অবশ্য নগরীর ব্যস্ততার কারনে নয়। বরং নগরের নানা ধরনের দৃশ্যমান অব্যবস্থাপনাই এমন মানসিকতা তৈরী হবার মূল কারণ। রাস্তা ভাঙ্গা কিংবা কাটাকাটি চলছে, কাঁদামাটিতে মাখামাখি, মেনহোলের ঢাকনা নেই, রাস্তার ধারেই বিশালাকার কাঁচা ময়লার স্তুপ, ফুটপাত হকারের দখলে, আর আছে কথায় কথায় যানজট। ইদানীং শহরের চেহারাও বদলে যাচ্ছে। পাশাপাশি দালানের সারি; কোনটি ছয়তলা, কোনটি দশ। এ কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব।
শুরুতেই নগর ব্যবস্থাপকদের এভাবে খোঁঁচা দেয়া ঠিক হল কি না জানি না। আমার এ কথায় তাদের আঁতে ঘা লাগতেও পারে। কিন্তু এসব লিখতে আমার হাতে কিংবা বলতে আমার দাঁতেও কোন সমস্যা হয় না। আবার তাদেরও আঁত আছে বলে আমার মনে হয় না। লেখালেখি বা বলাবলি কম তো আর হল না। কোন কিছুতে কোন কালেই তাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। থাকলে নগরীর এই হাল হবার কথা নয়। নগরীর এই হালহকিকত লেখা আজকের উদ্দেশ্যও নয়। প্রসঙ্গক্রমেই লিখতে হলো। আবার বেশী লিখলেও সমস্যা। কবে কোন চিঠি ধরিয়ে দেবে কে জানে! তাদের ক্ষমতা অনেক, তাই আর কিছু পারুক বা না পারুক চাইলেই কঠিন একখানা চিঠি ধরিয়ে দিতে পারে। এসব ধরাধরির কাজে ব্যস্ত থাকে বলেই হয়তো আসল কাজে গতি কম, ব্যর্থতা বেশী।
শক্ত ক্ষমতা আর পোক্ত বেতন ভাতা পাবার পরেও তাদের ব্যর্থতায় ইদানীংকালে নগরের ছোট অংশে বিভিন্ন কল্যান সমিতির নামে বেসরকারী সামাজিক ব্যবস্থাপনা তৈরী হচ্ছে। যারা সত্যিকার অর্থেই কাজ করছেন। নাগরিকদের নানা ধরনের সুবিধা অসুবিধা দেখভাল করছেন। শহরকে নিরাপদ রাখতে সদা সচেষ্ট থাকছেন। অথচ তাদের কাছে যেমনি সরকারী অর্থ নেই, তেমনি ক্ষমতাও নেই। থাকার কথাও নয়। ক্ষমতার মত মহামূল্যবান বিষয়টি ভোগ করার অধিকার তো কেবল সরকারীওয়ালাদের। তাদের সাথে ক্ষমতাসীনদের পার্থক্য অনেকটা সরকারী মিলিটারীর সাথে বেসরকারী সিকিউরিটি কোম্পানীর গার্ডের মত।
এমনি মূল্যহীন বেসরকারী এই সমাজকর্মীগন নিজেরাই নিজেদের মহল্লা কিংবা সমাজের স্বার্থে প্রথমে ক’জনে মিলে এক হয়ে নিজের গাটের টাকায় চা-নাস্তা খেয়ে ছোটখাট কমিটি করে কাজ শুরু করে। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে উন্নয়ন দৃষ্টিগোচর হয়, আর কমিটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। নজর পড়া শুরু হয় তখন থেকেই। অনেকেই ভীড়তে থাকে দলে। এই পর্যন্ত সবই ঠিক থাকে। এরপর শুরু হয় চতুরদের চতুরতা। তারাও আস্তে আস্তে দলে ভেড়ার চেষ্টা করে। এভাবে সংগঠনটি আরো বড় হয় বটে, তবে শুরু হয় বিপত্তি। স্থানীয় রাজনীতিক গুরুদের চোখ হয় বড়। আর খায়েশ হয় অনেক কষ্টে গড়ে তোলা সামাজিক সংগঠনের নেতৃত্ব দেবার। সামাজিক সংগঠনকে রাজনীতিকরনের এ এক সর্বনাশী খায়েশ।
তবে সব জায়গাতেই যে এমন হয় তা নয়। সবখানেই যে তারা খায়েশ পুরো করতে পারেন তাও নয়। সব বাঁধা পেরিয়ে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে প্রকৃত সমাজসেবকগন এগিয়ে যেতে পারে এমন নজিরও আছে। এর জন্যে প্রয়োজন নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা। দেহের কিংবা চাপার বলিষ্ঠতা এক্ষেত্রে মূখ্য নয়; না থাকলেও চলে। তবে মেধার বলিষ্ঠতা অবশ্যই জরুরী। আর জরুরী অন্যের রাঁধা পায়েশে ভাগ না বসাবার সুপ্ত খায়েশ।
এমনি একজন মেধাবী নিঃস্বার্থবান সামাজিক নেতাকে আমি খুব কাছে নয়, কিছুটা দূর থেকে চিনি। মাঝেমধ্যে কদাচিৎ রাস্তায় দেখা হয়, সালাম বিনিময় হয়। তবে বেশী দেখা হয় মসজিদের জামাতে। কথা খুব হয় না। চোখের ইশারাতেই ভাবের আদান প্রদান বলা যায়। দু’একবার ঘটনাক্রমে আমাদের অফিসেও এসেছেন। ঝাঝরা প্যাটার্নের বাবরী চুলের শুভ্রতায় তিনি মুখাবয়বে এক ভিন্নতা এনেছেন। সহজেই নজরে পরেন অন্যের; দৃষ্টি কাড়েন সবার।
ছোট্ট শহরের সবখানে তাঁর অবিরাম বিচরন। শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা; কোথায়ও পারতপক্ষে যানবাহনে চড়ে যান না। মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারেন। সামাজিক কর্মকান্ডের কোন সভা, মিটিং বা অনুষ্ঠানে তিনি নেই এমনটা কখনোই হয় না। শুধু উপস্থিতিই নয়, সব সময় থাকে তাঁর সরব উপস্থিতি। বক্তৃতাও করেন বেশ চমৎকার; সকলের দৃষ্টি কাড়ে। বিষয় ভিক্তিক আবেগী বক্তৃতা করে তিনি সবাইকে সম্মোহিত করেন। তাই তাঁর ডাক পড়ে সব জায়গায়। তিনি চোখে পড়েন সবার।
চোখে তো পরবেনই। চোখ নিয়েই তো তাঁর খেলা। তিনি চোখের ডাক্তার। হয়ত তাই নিজের চোখেরপাওয়ারও অনেক বেশী। সমাজের ভালমন্দ বেশ ভাল করেই দেখতে পান। সরকারী চাকুরী থেকে অবসরে যেয়ে তিনি এখন পুরোদস্তুর সমাজের ভালমন্দ দেখার কাজে মনোনিবেশ করছেন। রৌদ্র কিংবা বৃষ্টি, শীত কিংবা গরম; কোন কিছুতেই তিনি ঘরে বসে থাকেন না। আবার যতক্ষন ঘরে থাকেন ততক্ষন অনলাইনে সামজিক যোগযোগ মাধ্যমেই ব্যস্ত থাকেন। নানা বিষয়ে লেখেনও চমৎকার। অনলাইনে তাঁকে অনুসরনকারীর সংখ্যাও উল্লেখ করার মত।
তিনি প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ঢাকার উত্তরা ১১ সেক্টর কল্যান সমিতির সভাপতি ডাঃ মঈন ভাই। তাঁকে নিয়ে এই কলামে লেখার ইচ্ছে কিংবা সাহস আমার ছিল না। তাঁর পরিধি এমনিতেই অনেক বড়। আমাদের এই ছোট্ট প্রকাশনায় তাঁকে টেনে এনে ছোট করতে চাইনি। কিন্তু তাঁর একটি সৃষ্টকর্ম নিয়ে লেখার লোভ সামাল না দিতে পারাই তাঁকে নিয়ে আজকের ভূমিকা নিতে হলো। সৃষ্টিকর্মের স্রাষ্টাকে আমাদের পাঠককুলের কাছে একটু চেনাবার জন্যে এই ফিরিস্তি দেয়া।
তাঁর বাড়ীর পাশ দিয়েই প্রায় নিত্যদিন আসাযাওয়া করি। বাড়ীর বাহির দেয়ালে টানানো সাইনবোর্ডটি যে চোখে পরেনি তাও নয়। তবে তেমন করে ভাবা হয়নি। এই শহরে হাজার হাজার ডিজিটাল ব্যানারের ভীড়ে বর্ণহীন ছোটখাট সাইনবোর্ড এখন তেমন ভাবায়ও না। ব্যানার এখন পাতি নেতাদের দখলে। যেদিকে তাকাবেন কেবল তাদের মুখ আর মুখ। তাই আজকাল আর তাকাই না। আর তাই অনেক সাইনবোর্ডের ভীড়ে অতি সাদামাটা এই সাইনবোর্ডটিকে গুরুত্ব দেইনি। হয়ত এ কারনেই উন্মেষ পাঠশালা আমার আগ্রহের বাহিরেই থেকে গেছে এতদিন।
আমার মত সামান্য মানুষের আগ্রহ নিয়ে তো আর দুনিয়া চলে না। উন্মেষও চলেনি। তরতর করে এগিয়ে চলেছে দিনের পর দিন। যাঁর ভাবনা, পরিকল্পনা আর পরিচালনায় উন্মেষের পথ চলা, তিনি যতদিন চাইবেন ততদিন এটা চলতেই থাকবে এ ব্যাপারে আমার সামান্য সন্দেহও নেই। পরিকল্পনাটা পুরোপুরি মঈন ভাইয়েরই। তিনি অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করলেন শহরের আশপাশের বস্তিতে থাকা বিভিন্ন বাসার কাজের বুয়াদের কিংবা রিক্সা বা ভ্যানচালকদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা শহরেরই রাস্তা দিয়ে সারাদিন হাঁটাচলা করে বেড়ায়। কখনো এই বাসার সামনে কিছুক্ষন, কখনো বা অন্য কোথায়ও সময় কাটিয়ে দিন পার করে দেয়। তিনি নিশ্চিত হলেন লেখাপড়া ওরা করেনা।
মঈন ভাই এদেরকে স্কুলগামী করার জন্যে নিজের বাসার খোলা গ্যারাজে সেপ্টেম্বর, ২০১২ তে স্কুল চালু করে দিলেন। নাম একটা দিতে হয়, তাই দিলেন “উন্মেষ পাঠশালা”। পড়াবার লোক পাবেন কোথায়? তাঁর বাসার দারোয়ান মাহফুজই দায়িত্বটা নিয়ে নিল। প্রথমে একজন, দুজন করে আস্তে আস্তে শিক্ষার্থী বাড়তে লাগলো। এখানে দারোয়ান মাহফুজের শিক্ষক হিসেবে সফলতাও একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ব্যক্তি জীবনে মাহফুজ তিন কণ্যা সন্তানের জনক এবং তিনজনকেই নিজে পড়িয়ে গ্র্যাজুয়েশন করিয়েছেন।
মঈন ভাই এই অনুপ্রেরনা পেয়েছেন তাঁর শিক্ষক বাবার কাছ থেকে। সারাজীবন শিক্ষকতা করা তাঁর বাবা শত বছর বয়সে এখনো বেঁচে আছেন; দিব্যি হাঁটাচলা করেন। এমনি বাবার সন্তান বলেই হয়ত ক্ষমতা আছে কি নেই, সেটা ভাবেননি; অর্থ আছে কি নেই সেটা দেখেন নি। মন চেয়েছে, তাই শুরু করে দিয়েছেন। এখানে তাঁর মনের জোরটি বড় ভাবে কাজ করেছে। আজকাল আমাদের সমাজের ক্ষমতাবান এবং অর্থশালীদের সব থাকলেও মনের এই জোরটির বড় অভাব।
উন্মেষ পাঠশালাতে এখন শিক্ষার্থীর কোন অভাব নেই। মাত্র চার বছরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৬ জনে। শিক্ষক বেড়েছে। পাঠশালার পাশে থাকার জন্যে এগিয়ে আসছে সমাজের অনেকেই। কেউ অনুদান দিচ্ছে, কেউ বই দিচ্ছে, কেউ বা দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের ইউনিফর্ম। সেদিন অনেকগুলো টাকা পেয়েছে বই কেনার জন্যে। চালু করা হয়েছে পাঠাগার। বই রাখার জন্যে আলমিরা দরকার। দেবার মানুষের অভাব হয়নি। একটি সুন্দর আইডিয়া আর সঠিক নেতৃত্ব থাকলে কিভাবে অবিশ্বাস্যভাবে তা বাস্তবায়িত হয় তার জলন্ত উদাহরন এখন উন্মেষ পাঠশালা।
আমাদের পত্রিকার পাতায় এমনি চমৎকার সংবাদ ছাপানোর জন্যে দেশের সব পত্রিকার পাতা তন্য তন্য করে খুঁজে বেড়াই। কোথায়ও ভাল কিছুর গন্ধ পেলে আগ বাড়িয়ে নিজেরাই দৌঁড়ে যাই। কিন্তু নিজের বাড়ীর পাশের এই মহতী উদ্যোগে চোখ ফেলার সময় হয়নি ভেবে বিব্রত হয়েছি। আর আজো এটাকে নিয়ে ফিচার না করতে পারার ব্যর্থতায় কিছুটা লজ্জাও হয়েছে। তাই শেষ করার আগে লজ্জাবনত চিত্তে কবিগুরুর কাছ থেকে কিছুটা ধার করে বললে হয়ত ভুল বলা হবে না, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, পড়শী বাড়ীর আঙ্গিনাতে আলোর পরশ পাথর!!!-লেখকঃ উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।