পিনাকী ভট্টাচার্য ।।
গ্রিক পুরাণের ‘ব্রহ্মা’ জিউস খুব সুন্দর এক নগরী তৈরি করলেন পৃথিবীর লোকের জন্য। কিন্তু সেই শহরের উপাস্য দেবতা কে হবেন, তাই নিয়ে মনান্তর হল জিউসের মেয়ে এথেনা আর ভাই পসেইডিয়নের। পসেইডিয়ন ছিলেন সমুদ্রের দেবতা আর অত্যন্ত বদমেজাজি। সাইক্লোন, ঝড়, ঝঞ্ঝা, আর বিভিন্ন সামুদ্রিক উপদ্রবের দেবতা তিনি। অন্য দিকে এথেনা শুধু যুদ্ধ, শান্তি, জ্ঞান, ন্যায়, সভ্যতার আর শিল্পের দেবী। দুজনেই আপনজন, তার ওপর দুজনেই দেবতাদের ‘অলিম্পিয়াড’-এর সদস্য। ‘অলিম্পিয়াড’ বারো জন সবচেয়ে প্রভাবশালী দেবদেবীদের নিয়ে তৈরি। তাই জিউস নিজের ওপর সিদ্ধান্তের ভার না রেখে, আদেশ দিলেন দুই দেবতাকে। নতুন নগরীকে নতুন কিছু উপহার দাও, তার নিরিখে অলিম্পিয়াড-এর বাকি সদস্যরা বিচার করে জানাবেন নতুন নগরীর উপাস্য কে। সেই নতুন শহর ছিল সমুদ্রের উপকূলে, তাই পসেইডিয়ন সেখানে আগে পৌঁছে গেলেন। তিনি তাঁর বল্লম গেঁথে দিলেন মাটিতে, আর সেখানে তৈরি হল নোনা জলের এক কুয়ো। উল্লাসে ফেটে পড়ল তাঁর সমর্থকরা। এথেনা পৌঁছলেন কিছু পরে, নোনা জলের কুয়োর পাশে তিনি তাঁর বল্লম গাঁথলেন। বেরিয়ে এল অলিভ বা জলপাইয়ের এক গাছ। এই গাছ তার কাণ্ডের মাধ্যমে কাঠ দিল মানুষকে, ফলের মাধ্যমে দিল সুস্বাস্থ্য, আর বাণিজ্যের দরজাও খুলে দিল। ‘অলিম্পিয়াড’ এথেনাকে বিজয়িনী ঘোষণা করল আর তাঁকে নতুন শহরের উপাস্য দেবী বলে স্বীকার করল। এথেনার নামে মিলিয়ে নগরীর নাম হল এথেন্স।
অলিভ শুধু গ্রিক উপকথাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য ধর্ম আর সভ্যতাতেও। মিশরের ফারাও তুতানখামেনের সমাধিতে অলিভ গাছের ডাল পাওয়া গিয়েছে। হিব্রু বাইবেল আর ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে, যে পায়রা নোয়ার কাছে খবর এনেছিল যে বন্যা শেষ হয়েছে, বন্যার জল নেমে যাচ্ছে, তার ঠোঁটে অলিভের ডাল ছিল। কোরান শরিফে সাত বার অলিভের উল্লেখ রয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, রমজানের উপবাস ভাঙার সময় খেজুর না পেলে বদলে অলিভ ব্যবহার করা যেতে পারে। খেলার মাঠেও অলিভের বিশাল ভূমিকা, অলিম্পিক-জয়ীর মাথায় অলিভের মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয় সেই আদি কাল থেকেই। তখন অলিম্পিকে শারীরিক কসরতের সঙ্গে বাগ্মিতা আর বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষাও থাকত। কারণ এথেনা যে জ্ঞান আর শৌর্যেরও দেবী। রিও অলিম্পিকেও তাই ঐতিহ্য-মাফিক অলিভের মুকুট পরানো হয়েছে বিজয়ীদের।
মানুষ যে দিন থেকে গাছ পুঁততে শুরু করল, গাছের পরিচর্যা শুরু করল, সেই জমানার এক আদিম গাছ হল এই অলিভ গাছ। ৬০০০ বছর আগে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে গ্রিকদের বর্ণিত সূর্যোদয়ের দেশ ‘আনাতলিয়া’, মানে এখনকার তুর্কি থেকে এর যাত্রা শুরু বলে মনে করা হয়। অলিভ গ্রিস বা ক্রিট দ্বীপেই পৌঁছে গিয়েছিল সেই তাম্রযুগে, আজ থেকে ৫০০০ বছর আগে। রোমান যুগ থেকে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, অলিভ শৌর্য ছেড়ে শান্তির দূত হয়ে উঠেছে। প্রথম শতাব্দীর রোমান কবি ভারজিল তাঁর ‘ইনিড’ কাব্যে অলিভের ডালকে শান্তির প্রতীক হিসেবে দেখিয়েছেন। ৪ জুলাই ১৭৭৬-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম সিল তৈরি করে, তা ১৭৮০-র মার্চে পরিমার্জিত হয়। সেই নতুন সিলে অনেক কিছু বদলালেও বদলায়নি অলিভ আর অলিভ পাতা। এমনকী হালে ১৯৭৪ সালে যখন প্যালেস্তিনীয় নেতা ইয়াসের আরাফত রাষ্ট্রপুঞ্জ অধিবেশনে যান, তাঁর হাতে ছিল অলিভ গাছের ডাল।-সূত্রঃ ফেইসবুক