কী জাদু মোদিতে

এবার ভারতের লোকসভা নির্বাচন হয়েছে দুটি পক্ষের মধ্যে—একপক্ষে সব বিরোধী দল আর অন্যপক্ষে এককভাবে নরেন্দ্র মোদি। ভারতের হিন্দুত্ববাদী এই প্রধানমন্ত্রী গতকাল প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তাঁকে ঘিরেই ছিল এবারের নির্বাচন।

দল ছাপিয়ে নিজের সর্বভারতীয় ইমেজ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন তিনি। আর তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রচারও ছিল মোদিকেন্দ্রিক। প্রতিটি আসনে প্রার্থীদের যোগ্যতা-গুণ-দক্ষতাকে ছাপিয়ে প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন মোদি। আর বিজেপির এই নির্বাচনী কৌশল কতটা যথার্থ ছিল তার প্রমাণ গতকালের ফল। এর মধ্যে দিয়েই ভারতে আরো সর্বব্যাপী-সর্বগ্রাসী হয়ে উঠল বিজেপি।
কঠোর, তীক্ষ বিচক্ষণতা, ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার মোদির জনসমর্থনের ক্ষেত্রে কোনো মধ্যবর্তী অবস্থান নেই। মানুষ তাঁকে হয় ভালোবাসে, নয়তো ঘৃণা করে।

৬৮ বছর বয়সী মোদি প্রথমাংশের লোকদের নিয়েই এগিয়ে গেছেন। ২০১৪ সালে যখন তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রচার শুরু করেন তখন তাঁর স্লোগান ছিল ‘সবার উন্নতি’ (সাবকে সাথ সবকা বিকাশ), শুনিয়েছিলেন ‘আচ্ছে দিনের’ গল্প। এবার আর সেই ফাঁদ তৈরির চেষ্টাই করেননি মোদি। গত পাঁচ বছরে ভারতে যে বিষয়টির বিকাশ সবচেয়ে ভালোভাবে হয়েছে, তা হলো ‘হিন্দুত্ববাদ’। এ সত্য মোদি নিজেও খুব ভালোভাবেই বোঝেন। কাজেই ‘জাতীয়তাবাদের’ ধ্বজা ধরে মোদি এবার যে বার্তা সবার কাছে দিচ্ছেন, তা সংখ্যাগুরু তোষণেরই অন্য নাম। কাজেই গৈরিক বিপ্লব ছড়াতে গেরুয়াধারীদেরই সমর্থন, সমন্বয় প্রয়োজন। মোদি সফলভাবে সেই সমন্বয়ই করছেন।
কারণ গত পাঁচ বছরে মোদির ব্যর্থতার তালিকা কম নয়। নোটবন্দি, কর সংস্কার, বেকারত্ব, শ্লথ অর্থনীতি—দেশের মূল চালিকাশক্তি নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো এর পরও মোদি জনপ্রিয়। এ ক্ষেত্রে মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের সঙ্গে তুলনা করেছেন অনেকেই। রিগ্যানের আমলের মার্কিন অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়েছিল। কিন্তু অনন্য সাধারণ বাগ্মী রিগ্যানকে তার কোনো ত্রুটি স্পর্শ করতে পারেনি। পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন নির্বিঘ্নে। মোদিও সেই ক্যাটাগরির নেতা। ভাষাকে অলংকার পরিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর করে জনতার সামনে উপস্থাপনে তাঁর জুড়িদার ভারতবর্ষে নেই।

পরিস্থিতি তৈরি করে তার ফায়দা নেওয়ার কায়দাটিও খুব ভালো করেই জানা আছে মোদির। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার (ওই ঘটনায় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সেনা নিহত হয়) ঘটনা এবং তৎপরিস্থিতিতে মোদিকে এগিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। যার স্পষ্ট প্রভাব পড়েছে তাঁর জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারে। পারদ উঠেছে। আর সেই পারদকে আরো গগনমুখী করতে নিরাপত্তা ও দেশপ্রেমকেই হাতিয়ার করেছে মোদি বাহিনী। উন্নতি, সমৃদ্ধি বা সবার বিকাশের এবার আর গুরুত্ব নেই। শব্দ হিসেবে অবশ্যই আছে। তবে মোদির ব্রহ্মাস্ত্র সেই হিন্দুত্ববাদ আর তাদের সংজ্ঞা অনুসারে দেশপ্রেম।

æআর এই দুইয়ের রসায়নে এবারের নির্বাচনকে মোদি অনেকটাই তৈরি করে নিয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল আদলে। নিজেকে পুঁজি করে ৯০ কোটি ভোটারের এই লড়াই তিনি যেভাবে লড়েছেন তা মনে করিয়ে দেয় মার্গারেট থ্যাচার বা টনি ব্লেয়ার বা ইন্দিরা গান্ধীকে। ১৯৭১ সালের পর এত জনপ্রিয় নেতা ভারত আর পায়নি।

‘৫৬ ইঞ্চি ছাতির’ মোদি অনেকটাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আদলে চলেন। অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কখনোই কোনো সংবাদ সম্মেলনে অংশ না নিলেও টুইটারে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা চার কোটি ৬০ লাখ। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক তিনি। এ মাধ্যমে তাঁর তৎপরতাও মন্দ নয়। যদিও সাংবাদিকদের মুখোমুখি বসতে চান না তিনি। গত পাঁচ বছরে কয়েকটি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। নিন্দুকরা জানান, সবই ‘সুলিখিত নাটক মঞ্চস্থ’ করার মতোই ঘটনা। আর সংবাদ সম্মেলন করেছেন একটি। যেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী একটি শব্দও খরচ করেননি।

নিজেকে ভূমিপুত্র দাবি করা মোদি একসময় রেলস্টেশনে চা বেচতেন। এখনো গর্ব করে বলেন, ‘চা বেচেছি, দেশ বেচে দিইনি।’ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁর সময়ই গুজরাটে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। দাঙ্গায় হিন্দুদের পক্ষে তাঁর প্রচ্ছন্ন সম্মতি ছিল—এমন অভিযোগ বহুবার উঠেছে। তবে ওই অভিযোগ মোদির পায়ের বেড়ি হয়ে উঠতে পারেনি।-কালেরকন্ঠ