ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ শীতের জাপান। মার্চের হিমশীতল শীত। বাংলাদেশের সাথে তুলনা করলে কনকনে তো বটেই। ওভারকোট গায়ে চাপিয়ে হাতে হাত মোজা পড়ে বেরুলেও শীত লাগে। শীত গায়ে লাগে, পায়েও লাগে। একটু হালকা বাতাস থাকলে তো কথাই নেই। গা শিরশির করে শীত করে। শীত গুলো সব সুঁইয়ের মত শরীরে বিঁধে। যদিও এদেশে শীত বিদায় নেবার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তারপরেও মাত্রাটা এখনো মারাত্মক তীব্র। তাপমাত্রা এখনো মাইনাসে। কেবল ভর দূপুরে প্লাস হয়। ফেব্রুয়ারী হলো সর্বাধিক শীতের সময়। দাঁত ঠকঠক করানো কনকনে শীতের সময়।
দু’দিন হয় টোকিও এসেছি। না এসে উপায় ছিলনা। কাজের প্রয়োজনে আসতেই হয়। সাধারণত জানুয়ারী, ফেব্র“য়ারী, মার্চ; এই তিনমাস শীতের দেশ এড়িয়ে চলি। কিন্তু পারি না। টোকিওতে আরো মাসখানেক পরে আসতে পারলে ভাল হতো। শীত অনেকটাই কম থাকতো। থাকতো বসন্তের আমেজ। জাপানের বসন্ত উপভোগ করার মত। ঝরাপাতার ডালে ফুল ফোটে। সারা গাছভর্তি কেবলই ফুল; কোন পাতা নেই। অপূর্ব সাকুরা ফুল। পুরো জাপান সাদা হয়ে যায়। মাইলের পর মাইল লাইন ধরে থাকা সাকুরা গাছের সাদাশুভ্র ফুলে জাপান এক ভিন্ন রূপ ধারন করে।
এমনি পাতাঝরা সাকুরা গাছের বিশাল পার্কের সামনেই হোটেল। চুপচাপ হোটেল রুমেই বসে আছি। মর্নিং এ মিটিং ছিল বাইরে। আজ আর বের হবো না। তেমন কাজও নেই। যেটা ছিল, সেটাও ক্যান্সেল করেছি। হিটার চলাতে পুরো রুমটাই গরম। বাইরের সাথে ভেতরের কোন মিল নেই। এমনই পরিবেশে ভাল থাকার কথা। কিন্তু পারছি না। চেষ্টা করেও ভাল থাকতে পারছি না। মনটা বরাবরের মতই খারাপ। আমার শোনিমকে ছাড়া কোথায়ও গেলে কখনো ভাল থাকতে পারিনা। রাজ্যের ভাবনা ভর করে। শুধু ওর মুখটা ভাসে।
দুই যুগ আগে যখন এদেশে আসি, তখনও এমন হতো। আব্বা-আম্মার মুখটা ভাসতো। বিশেষ করে মায়ের মুখখানা ভুলতেই পারতাম না। খুবই একা লাগতো। হোম সিকনেস বিষয়টি তখন মনের মধ্যে শক্ত হয়ে চেপে বসেছিল। ঘরে থাকলে সিকনেস বিষয়টি বেড়ে যায়। তাই অবসরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। ঘুরতে ঘুরতে একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। দোকান ভর্তি চাল দেখার সুযোগ হয়েছিল। বস্তায় বস্তায় চাল। দোকানের ভেতরে চাল, বাইরে চাল।
রহস্য জানার চেষ্টা করলাম। সুপারভাইজিং প্রফেসর বুঝিয়ে বললেন, এ বছর ধানের ফলন ভাল হয়নি। বেশ মন্দা গেছে। প্রাকৃতিক কারণে কৃষক ৩০% ফলন কম পেয়েছে। সমস্যাটা একারনেই। আমি বুঝে উঠতে পরলাম না স্যারের কথা। এবার তিনি বুঝিয়ে বললেন, ফলন কম হবার কথা শুনে সরকার বিদেশ থেকে আগেভাগেই চাল আমদানি করেছে। এদিকে জনগণও সচেতন। ফলন কম বলে তারা ভাত খেতে সতর্ক হয়েছে। খাবার ম্যানুতে ভাতের পরিমান কমিয়ে দিয়েছে। গেল ক’মাস ধরে জাপানীজরা ভাত তেমন খায় না। এতে ফল যা হবার তাই হয়েছে। চালের ব্যবহার কমে যাওয়ায় চালের মজুদ বেড়ে গেছে। অবিক্রিত চাল এখন বস্তায় বস্তায় এখানে সেখানে পরে আছে। কেনার লোক নেই।
আমি হা হয়ে শুনছিলাম। হা হয়ে শুনবারই কথা। যে দেশ থেকে আমি জাপানে গিয়েছি, হা হয়ে শোনা ছাড়া আমার আর কীইবা করার ছিল। মনে মনে দেশের কথা ভাবলাম। হতো যদি বাংলাদেশ! চাল নিয়ে কথা চালাচালি করতে করতে সরকারকে ঘরের চালে উঠাতো। যত রকমের প্যানিক আছে, মিডিয়া সব দিত; চারিদিকে হাহুতাশ ছড়াতো। এতে মানুষের ভাত খাওয়া উল্টো বেড়ে যেত। আতঙ্কে “এই বুুঝি চাল শেষ, এই বুঝি সব শেষ” ভাবতে ভাবতে সবাই দেড়গুণ পরিমানে ভাত খেত। আর মজুদ করতো। যে যত পারতো করতো। যে জাতি রমজানে বেগুন, বর্ষায় পেঁয়াজ আর শীতকালে কাঁচামরিচ মজুদ করতে পারে, সে জাতি ভাতের চাল মজুদ করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
অথচ উল্টো করতে পারতো। বাজারে কোন কিছুর ঘাটতির কথা শুনলেই ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারতো জাপানীজদের মত। ওরা কেবল খাবার নয়, সব কিছু ব্যবহারে সাংঘাতিক রকমের সতর্ক।
ক’বছর আগে ফুকুশিমায় সুুুনামীর ক্ষয়ক্ষতিতে সবচেয়ে বিপদে পড়লো জাপানের বিদ্যুৎ খাত। ২৫% বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিল। সরকারকে কিচ্ছু বলতে হলো না। যে যার জায়গায় সতর্ক হয়ে গেল। রেল কোম্পানীগুলো দ্’ুএকটা বাদে রেলস্টেশনের সব লিফট এবং বৈদ্যুতিক সিঁড়ি বন্ধ করে দিল। যাত্রীগণ হলো আরো বেশী সতর্ক। তারা চালু থাকা লিফটেও চড়লো না। বুড়োদের দলও হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি বাইতে লাগলো।
বাসাবাড়ী কিংবা অফিস আদালতে সবাই এসি ব্যবহার টোটালি বন্ধ করে দিল। কিনে নিল হাত পাখা। অপ্রয়োজনে একটি বাল্বও জ্বালালো না। বিদ্যুৎ আছে সবখানে, কিন্তু কেউই ব্যবহার করে না। অবশেষে হলো নতুন সমস্যা। বিদ্যুৎ কোম্পানী মহা বিপদে পড়লো। ব্যবহার কমিয়ে দেয়াতে উৎপাদিত ৭৫% বিদ্যুতেরও একটা অংশ অব্যবহৃত থাকলো। ফলত লোকসান গুণতে শুরু করলো বিদ্যুৎ কোম্পানী। তারা বিদ্যুৎ বানায়, বানাতে খরচ হয়। কিন্তু বিক্রি করতে না পারলে লোকসান গুণতে হয়। অগ্যতা বাধ্য হলো বিজ্ঞাপন দিয়ে অনুরোধ করতে যেন জনগণ আরো বেশী বিদ্যুৎ ব্যবহার করে।
ঠিক এই জায়গায় আমাদের দেশের চিত্রটি উল্টো। বিদ্যুৎ না থাকলে মোমবাতি দিয়ে চলতে পারে। সারা ঘরে দু’চারটে মোমবাতি জ¦ালিয়ে কাজকর্ম সারতে পারে। কেউ কেউ অন্ধকারেও বসে থাকে। টয়লেটের চিপায় বসে অন্ধকারেও কর্ম সারে। তখন সব পারে। শরম সইতে পারে। তেলাপোকার জ¦ালাও সইতে পারে। গরম সইতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ আসার পর কিছুই পারে না। যেইনা বিদ্যুৎ ফিরে আসে, অমনি সারা ঘরের সব বাতি না জ¦ালিয়ে চলতে পারে না। সব বাতি, সব ফ্যান এক সাথে জ¦লে উঠে। সব এসি চালু হয়। ব্যাপারটি এরকম যে, না থাকলে কিছুই লাগে না; সব চলে। আর থাকলে সব লাগে।
বড় অদ্ভুত এক জাতি আমরা। অবশ্য আমরা অদ্ভুত, নাকি ওরা অদ্ভুত সেটিও একটি প্রশ্ন। জাপানীজদের কাজকর্ম দেখলে মাঝেমাঝে এমনই মনে হয়। অনেক আগের কথা। জাপানে আমি অনেকটাই নতুন। বছর দুই আগে কেনা আমার কম্পিউটারের প্রিন্টার নষ্ট হলো। মেয়াদ চেক করে দেখলাম আর মোটে তিনদিন পরেই মেয়াদ শেষ। কলসেন্টারে ফোন দিলাম। ওরা তো মাফটাফ চেয়ে একাকার। এমনভাবে মাফ চাচ্ছে যেন পুলিশের হাতে সদ্য ধরা পড়া আসামী। কাঁচুমাচু দিয়ে নিশ্চিত করলো, কালকেই লোক পাঠাবে বাসায়। খুবই বিনয়ের সাথে আমার সুবিধাজনক সময়ও জেনে নিল।
পরদিন সময় হতেই কলিং বেলের আওয়াজ। দরজা খুলে দেখলাম মাথা নীচু করে একজন দাঁড়িয়ে। শুভ সকাল বলে বাসায় ঢুকলো। কাঁধে রাখা সদ্য বাজারে আসা লেটেষ্ট মডেলের প্রিন্টারটাকে একপাশে রেখে আবারও শুরু করলো মাফ চাইবার পর্ব। হাঁটু গেড়ে মাথা নীচু করে শুরু হলো ডায়গল; স্যরি, খুবই স্যরি। আমাদের কোম্পানীর প্রিন্টার ব্যবহার করে তোমার খুবই বিপদ হয়ে গেল। কাল থেকে নিশ্চয়ই তুমি কাজ করতে পারছো না। এভাবে তোমাকে বিব্রত করার জন্যে আমরা খুবই দুঃখিত।
এককাপ চা অফার করলাম। বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিল আমায়। কেবল বিনয় আর বিনয়। ঝটাপট নতুন প্রিন্টারটি সেটআপ করে পূরনোটা সরিয়ে নিল। সরিয়ে নিল টেবিলে জমানো সব ময়লাগুলো। রাখলো তার নিজের ব্যাগে। নতুন টাওয়েল দিয়ে আমার পুরো টেবিলটা বারবার মুছে পরিষ্কার করে দিল। এবার বিদায়ের পালা। আমার হাতে একটা চকলেটের প্যাকেট দিয়ে বললো, তেমন কিচ্ছু না। খুবই সামান্য একটা গিফট। গ্রহন করলে খুশী হবো।
কথাটি বলে আর দাঁড়ায়নি। আমার দোতলা ঘরের বাসা থেকে নীচে নেমে গাড়ী স্টার্ট দিয়েই চলে গেল। আমি হতবাক চিত্তে তাকিয়ে, ততক্ষণ! যতক্ষন গাড়ীটিকে দেখা যায়। অদ্ভুত এই মানুষটিকে বিদায় দিয়ে আমি নির্বাক। আনমনে অবাক বিষ্ময়ে কেবল তাকিয়ে রইলাম। আমার ঘোর কাটে না। চোখের পলক পড়ে না। এছাড়া আমার আর কিইবা করার ছিল! বড় অদ্ভুতভাবে অদ্ভুত দেশের অদ্ভুত এই মানুষটিকে পেছন থেকে আনমনে দেখা ছাড়া আমার আসলেই আর কিচ্ছু করার ছিল না!!-লেখকঃ উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।